শাবান মাস হলো রমজানের আগমনের বার্তাবাহক যা রমজানের মতোই পবিত্র ও বরকতময়। শাবান মাস হলো রমজানের প্রস্তুতির মাস। যেমন একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করে, তেমনি মুমিনরা সাবান মাসে ইবাদত ও তওবা ইস্তেগফার করে রমজানের জন্য প্রস্তুতি নেয়। তাই চলুন শাবান মাস থেকেই আমরা রমজানের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। আসুন জেনে নিই এ মাসের করণীয় বর্জনীয় আমলসমূহ এবং ইসলামী শরীয়তে শাবান মাসটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ-
কেন শাবান মাস গুরুত্বপূর্ণ?
শাবান মাস কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আমরা কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। আশা করি, এর মাধ্যমে আপনি এই মাসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাবেন।
- সহীহ বুখারি, হাদিস: ১৯৬৯
- সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৫৬
- সুনানু আবী দাউদ ২/৩০০ (২৪৩৪)
- আসসুনানুল কোবরা লিলবায়হাকী ৪/৪৮২ ( ৮৪২৮)
আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন:
“আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো এত বেশি রোজা রাখতেন যে, আমরা মনে করতাম তিনি আর ইফতার করবেন না। আবার কখনো এত বেশি ইফতার করতেন যে, আমরা ভাবতাম তিনি আর রোজা রাখবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোজা রাখতে দেখিনি। তবে আমি কোনো মাসে তাঁকে শাবান মাসের মতো এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি।
হজরত উসামা (রা.) আরও বললেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কোনো মাসে আপনাকে এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি, যতটা শাবান মাসে আপনাকে রোজা রাখতে দেখেছি। এর কারণ কী?”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “শাবান এমন একটি মাস, যা রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী সময়ে আসে। এ মাসে মানুষ সাধারণত উদাসীন থাকে। অথচ এটি এমন একটি মাস, যাতে বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার আমল যেন রোজা অবস্থায় পেশ করা হয়।”
আয়িশা (রাযি.) বলেন, “নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শাবান মাসের চাঁদের প্রতি এমন সতর্কতা অবলম্বন করতেন, যা অন্য কোনো মাসের চাঁদ সম্পর্কে তিনি কখনোই করতেন না।
9. সুনানু ইবনে মাজাহ , হাদিস নং: ১৩৯০
আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন। (হাদিসের মান: হাসান)
আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন রজব মাস শুরু হতো, তখন নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই দোয়া করতেন:
“হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং রমজান মাস পর্যন্ত আমাদের জীবন প্রলম্বিত করুন।”
আবু সালামা (রহ.) থেকে বর্ণিত, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন:
“আমি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কোনো মাসে শাবান মাসের মতো এত বেশি রোজা রাখতে দেখিনি। তিনি শাবান মাসে সামান্য সময় ব্যতীত প্রায় পুরো মাস রোজা রাখতেন, বরং কখনো কখনো তিনি পুরো মাসই রোজা রাখতেন।”
আব্দুর রাযযাক (রহ.) আমাদের জানান, তিনি বলেন, মা‘মার (রহ.) আমাদেরকে ক্বাতাদাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
“শাবান মাস এবং রমজান মাসের মধ্যে এক বা দুই দিনের বিরতি রাখো, অর্থাৎ ঐ দিনগুলোতে রোজা রেখো না, অথবা এ জাতীয় কোনো পন্থা অবলম্বন করো।”
উপরোক্ত হাদিসগুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, শাবান মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। সুতরাং, এ মাসকে অবহেলায় কাটিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথে এই মাসে আমল করা উচিত। তাই নিম্নে শাবান মাসের কিছু করণীয় ও বর্জনীয় আমল উল্লেখ করা হচ্ছে।
শাবান মাসে করণীয়:
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, শাবান মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। এই মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক ইবাদত-বন্দেগী করতেন। তাই, আমরা এই মাসে বিভিন্ন ইবাদত- বন্দেগি ও তাওবা-ইস্তেগফার করে রমজানের প্রস্তুতি নিতে পারি। এক্ষেত্রে সব ধরনের অন্যায় কাজ থেকে বিরত থেকে প্রত্যেকেই নিজস্ব সাধ্য অনুযায়ী আমল করতে পারি। ইবাদতের ক্ষেত্রে কোন সীমা নেই। তবে সকলের সুবিধার্থে কুরআন সুন্নাহর আলোকে নিচে কিছু করণীয় আমলের তালিকা দেওয়া হলো।
- আত্মশুদ্ধি ও তওবা-এস্তেগফার:
আত্মশুদ্ধি হলো আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ, কারণ ইবাদত তখনই কবুল হয়, যখন অন্তর পরিশুদ্ধ থাকে। শাবান মাসে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নিজেদের আত্মাকে পাপমুক্ত করা। ইবাদত তাওবা-ইস্তেগফার দ্বারা অন্তরের পরিশুদ্ধি লাভ করে, যা আমাদের রমজান মাসে সঠিকভাবে ইবাদত করার জন্য প্রস্তুত করে।
শাবান মাসে আল্লাহর কাছে তাওবা করা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদের দোষ-ত্রুটি মুছে ফেলে, আর আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। যেভাবে শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে দেহ সুস্থ থাকে, তেমনি তাওবা ও ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরও পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে। এই পরিশুদ্ধ অন্তরেই রমজানের ইবাদত ও ত্যাগের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।
- বেশি বেশি নফল রোযা রাখা
এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে অধিক নফল রোযা পালন করা উচিত। এটি আত্মশুদ্ধি এবং রমজানের প্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নফল রোযা আমাদের মন ও আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং রমজানের জন্য প্রস্তুতি তৈরি করে।
- বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা:
- বিশেষ করে তাহাজ্জুদের প্রতি যত্নশীল হওয়া।
- দোয়া ও জিকির-আজকার
শাবান মাসে আল্লাহর স্মরণে সময় কাটানো এবং অধিক দোয়া ও জিকির করা সুন্নত। বিশেষত শবে বরাতে ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়া করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
- বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত:
বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে আমরা আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতে পারি।
- বেশি বেশি দান-সদকা:
দরিদ্রদের সাহায্য করে এবং দানে মনকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর রহমত অর্জন করা। এটি রমজানের জন্য আত্মিক প্রস্তুতির অংশ।
শাবান মাসে বর্জনীয়:
শাবান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগি ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে রমজানের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তবে, এই বরকতময় সময়টিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য আমাদের অবশ্যই কিছু বিষয় থেকে বিরত থাকা উচিত। এমন অনেক কাজ আছে, যেগুলো শাবান মাসের ফজিলত অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং রমজানের প্রস্তুতিকে নষ্ট করতে পারে।
শাবান মাসের পবিত্রতা রক্ষা এবং এর ফজিলত থেকে সর্বোচ্চ উপকার লাভ করতে হলে, এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যা ইসলামি শিক্ষার বিপরীত বা ইবাদতের মনোযোগ নষ্ট করে। এ মাসে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আত্মশুদ্ধি, তাওবা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। তাই, শাবান মাসে যেসব কাজ নিষিদ্ধ বা অযথা সময়ের অপচয় ডেকে আনে, সেগুলো থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
নিম্নে এমন কিছু বর্জনীয় কাজের তালিকা উল্লেখ করা হলো, যা শাবান মাসের ফজিলত নষ্ট করতে পারে এবং আমাদের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে:
- ইবাদতে উদাসীনতা:
শাবান মাসের বরকত ও ফজিলত উপেক্ষা করে ইবাদতে অলসতা করা এবং সময় অপচয় করা উচিত নয়। এই মাসে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা উচিত। - বিভ্রান্তি ও কুসংস্কার প্রচলন:
১৫ই শাবান রাত, আমরা যাকে শবে বরাত হিসেবে চিনি, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা নিয়ে আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিভ্রান্তি ও অজ্ঞতা রয়েছে সেগুলো থেকে বেঁচে থেকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে সঠিক ইবাদত করা উচিত।
এ বিষয়ে অচিরেই আমাদের ওয়েবসাইটে একটি বিস্তারিত লেখা প্রকাশ হবে, ইনশাআল্লাহ। অনুগ্রহপূর্বক আমাদের ওয়েবসাইটে চোখ রাখুন এবং নতুন আপডেটের জন্য যুক্ত থাকুন।
- গুনাহের কাজ করা:
এই মাসে মিথ্যা বলা, গীবত করা, চোগলখোরি বা অন্য কোনো গুনাহের কাজ করা উচিত নয়। এর মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে।
অবশ্য এগুলো থেকে সর্বদাই বেঁচে থাকা আবশ্যক। আমাদের উচিত পাপমুক্ত হয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে মনোযোগী হওয়া।
- লোক দেখানো ইবাদত:
ইবাদত-বন্দেগি করার সময় শুধুমাত্র লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কাজ করা বা রিয়া (দেখানোপনা) করা উচিত নয়। এটি ইবাদতের সওয়াবকে নষ্ট করে।
- ফজিলতপূর্ণ রাতের অতিরঞ্জন:
বিশেষত শবে বরাতকে ঘিরে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যা কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইবাদত হতে হবে সরল, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
- ইসলামি শিক্ষা ও সুন্নাহর প্রতি অবহেলা:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষা অনুযায়ীই শাবান মাসের আমল করা উচিত।
নিজের মতো করে এরকম কোন আমল করা যাবে না যা শরীয়তের সাথে সংঘর্ষিক।
- হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া:
গান-বাজনা, অপসংস্কৃতি, অপব্যয়, বা সময় নষ্ট করার মতো কাজ করা উচিত নয়। এগুলোর মাধ্যমে রমজানের প্রস্তুতির মধ্যে ব্যাঘাত ঘটে। অবশ্য এগুলো ইসলামে নিষিদ্ধ।
- অবহেলা ও দেরি করা:
রমজানের প্রস্তুতিতে উদাসীন থাকা বা প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা না করা উচিত নয়। এই মাসকে রমজানের জন্য সর্বোত্তম প্রস্তুতির সময় হিসেবে কাজে লাগানো জরুরি।
মোটকথা:
শাবান মাসের প্রকৃত ফজিলত ও বরকত পেতে হলে আমাদের অবশ্যই উপরোক্ত কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনা মেনে এবং কুরআনের আলোকে আমল করলে আমরা এই মাসকে রমজানের জন্য প্রস্তুতির মাস হিসেবে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
উপসংহার:
শাবান মাস অত্যন্ত বরকতময় ও গুরুত্বপূর্ণ সময়, যা আমাদের রমজানের প্রস্তুতির জন্য এক মহাসুযোগ প্রদান করে। এই মাসের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের আত্মা পরিশুদ্ধ করতে পারি, তাওবা-ইস্তেগফার করে আল্লাহর নিকট নৈকট্য অর্জন করতে পারি, এবং রমজানের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাসে অধিক ইবাদত করতেন, যা আমাদের জন্য অনুসরণীয়।
তবে, এই মাসের সঠিক উপকারিতা লাভ করতে হলে, আমাদের উচিত ইবাদতে মনোনিবেশ করা, বিভ্রান্তি ও কুসংস্কারের প্রতি নজর না দেয়া, এবং শাবান মাসের ফজিলত নষ্ট না করে সময়ের সদ্ব্যবহার করা। আল্লাহর দয়া ও ক্ষমা কামনা করে, আমরা যেন শাবান মাসে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রমজান মাসে সঠিকভাবে ইবাদত করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহায়তা করুন এবং শাবান মাসের বরকত আমাদের জীবনে পূর্ণতা লাভ করুক। আমিন।
আরো পড়ুন-
সেল্ফ মাই ডিজিটাল বিজনেস প্ল্যাটফর্ম কি জায়েজ ? একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা।