মাওলানা রহমাতুল্লাহ রহ.: জীবন, কর্ম ও অবদান

মাওলানা রহমাতুল্লাহ রহ.: জীবন, কর্ম ও অবদান

রঈসুল মুআল্লিমীন হযরত মাওলানা রহমাতুল্লাহ রহ. ছিলেন একজন বলিষ্ঠ, নির্ভীক ও প্রজ্ঞাবান আলেম। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কুরআনের খেদমত করে গেছেন । একই সঙ্গে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “জামিয়া নূরামিয়া তারাপাশা কিশোরগঞ্জ” এ হাদীসের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ ‘বুখারী শরীফ’ এর দরস প্রদান করে গেছেন, যা তাঁর গভীর জ্ঞান, বিশুদ্ধ চিন্তাভাবনা এবং ইসলামের প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রমাণ। তিনি আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেলেও তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আজও আমাদের জন্য অফুরন্ত প্রেরণার উৎস এবং ইসলামের পথে চলার অবিচল দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশের ইসলামী ইতিহাসে এমন কিছু বরেণ্য আলেম আছেন, যাঁদের ত্যাগ, খেদমত ও গভীর প্রজ্ঞা জাতির জন্য চিরন্তন আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. এবং তাঁর সতীর্থ কিংবদন্তি আলেম হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.। তারা ইসলামের সুমহান আদর্শকে জীবনের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় ধারণ করেছিলেন। তাঁদের সত্তায় ইসলামের সৌন্দর্য এমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল যে, তা শুধু তাঁদের চরিত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এর আলোকরশ্মি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরা ছিলেন সর্বজনস্বীকৃত বুযুর্গ, কুরআনের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তাঁদের হৃদয় সদা উদ্দীপ্ত ছিল।

১৯৮১ সালে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রহ. যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, তখন তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে এক অসাধারণ স্বপ্ন তুলে ধরেন। যা আজও আমাদের মনের গভীরে গেঁথে রয়েছে। তিনি বলেছিলেন,

“যদি আমি নির্বাচিত হই, তবে আমি দেশব্যাপী আটষট্টি হাজার গ্রামে গ্রামে মক্তব প্রতিষ্ঠা করব, যেখানে প্রতিটি শিশু, প্রতিটি মানুষ কুরআনের সুমহান শিক্ষা লাভ করবে।”

এই মহান আলেমদের স্নেহ, শিক্ষা ও নিকট সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন রঈসুল মুআল্লিমীন হযরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.। যিনি ছিলেন কুরআনের প্রতি গভীর প্রেম ও আত্মনিবেদনের এক অনন্য প্রতীক। তাঁর একাগ্র সাধনা ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে কুরআনের সুমহান শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে। আজও তাঁর দেখানো পথে, তাঁর গড়ে তোলা অগণিত আলেম কুরআনের আলো ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন।

তাঁর দীর্ঘ জীবন ও অসংখ্য বুযুর্গের সোহবত থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের আলো আজও অনন্য। বিশেষত ‘নূরানী কুরআন শিক্ষা’ ও ‘নূরানী মু’আল্লিম প্রশিক্ষণ’-এ তাঁর অগ্রগণ্য ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । তাঁর জীবন-কাহিনী ও অনন্য কীর্তি জানার আগ্রহ মানুষের হৃদয়ে এক গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যেই তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত স্মারক প্রকাশিত হয়েছে। সেই স্মারক গ্রন্থ থেকে আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাঁর জীবন ও কর্মের কিছু ঝলক তুলে ধরার মাধ্যমে তার ভক্ত,মুহিব্বীন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

জন্ম ও পরিচয়-

রঈসুল মুআল্লিমীন, হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ১৯৪০ সালের ১০ অক্টোবর, ঐতিহাসিক চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার কৃষ্ণপুর (পরবর্তীত নাম ইবরাহীমপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইবরাহীমপুর নিবাসী, জনাব মৌলভি ওয়ালিউল্লাহ সাহেব রহ.-এর সন্তান।

মৌলভি ওয়ালিউল্লাহ সাহেব কর্মজীবনে ছিলেন একজন পুণ্যবান ইমাম। তিনি পূর্বে ব্যবসায়ের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। জ্ঞান ও আমলে তাঁর খ্যাতি এ অঞ্চলে সুদূরপ্রসারী ছিল। সততা, নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা এবং বদান্যতার জন্য তিনি ছিলেন সমাজের এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। যে কোনো মজলিস বা দরবারে তিনি বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হতেন। তাঁর গাম্ভীর্যপূর্ণ স্বভাব ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কারণে সমাজে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিলো।

তাঁর মাতা, শামছুন্নাহার ছিলেন আল্লাহভীরু, পর্দানশীন ও ধার্মিক এক নারী। সংসারের প্রতিটি দায়িত্ব তিনি পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পালন করতেন । দুই ভাই ও এক বোনের মাঝে মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন । তাঁর বড় একজন বোন ছিলেন।

বাল্যকাল-

শৈশব থেকেই মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন সুশৃঙ্খল জীবনযাপনকারী এবং সুশ্রী চেহারার অধিকারী। তাঁর আচার-আচরণে সর্বদা ভদ্রতা ও বিনয় ফুটে উঠত । কথাবার্তায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিষ্টভাষী এবং সবার সঙ্গে মুচকি হেসে কথা বলতেন। খেলাধুলার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। এ সময়টাতে হয়তো প্রয়োজনীয় কাজ সারতেন, না হয় একাকী সময় কাটাতেন। তাঁর এই শান্ত ও ধীরস্থির প্রকৃতি ভবিষ্যৎ জীবনে তাঁর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।

বাল্যকালের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা-

মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছোটবেলা থেকেই তাঁর অনন্য গুণাবলীর জন্য পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে, বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল, তা অনেকেরই মনে আছে। সেসময় মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন মাত্র দশ বছরের এক বালক। সেই রাতের ঝড় ছিল মহা কপ্রলয়ঙ্করী। সে মুহূর্তে মাত্র দশ বছর বয়সী “রহমতুল্লাহ” এক অবিস্মরণীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে তাঁর অগাধ ঈমান ও সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।

রাত থেকে শুরু হওয়া প্রবল ঝড়ে তাদের ঘরটি প্রচণ্ডভাবে দুলতে শুরু করেছিল। ঘরটির কাঠামো ছিল অন্যান্য ঘরের তুলনায় বেশ দুর্বল, ফলে তা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। এমন অবস্থায় তাঁর আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “চল, আমরা এই ঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাই।” এতে তিনি রাজি হননি। তার আম্মাজান বারবার তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য বলছিলেন কিন্তু এতো জোরাজুরি সত্ত্বেও‌ বালক “রহমতুল্লাহ” ঘর ছেড়ে বের হতে রাজি হলেন না। বরং তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিলেন,

 “আল্লাহ যদি আমাকে রক্ষা করতে চান, তবে এখানেই করবেন। আর যদি মৃত্যুর ফায়সালা হয়ে থাকে, তবে যেখানে যাই না কেন, মৃত্যু আসবেই।”

পরিস্থিতির তীব্রতায় তাঁর আম্মা বাধ্য হয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন, সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর ছোট বোনকেও। কিন্তু বালক রহমতুল্লাহ একাকী ঘরে রয়ে গেলেন। তিনি ঘরের এক কোণে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করতে লাগলেন।

সকালেও ঝড় থামেনি। চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ—গাছপালা উপড়ে গেছে, ঘরবাড়ি লণ্ডভণ্ড। কিন্তু সবার বিস্ময়ের বিষয়, যে ঘরটি রাতভর ঝড়ে প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, সেটি বরং আগের চেয়েও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে আশপাশের লোকজন হতবাক হয়ে গেল। সবাই ছুটে এসে ছোট্ট এই বালকের ঘরে আশ্রয় নিল।

এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বালক “রহমতুল্লাহর” ঈমানের গভীরতা এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর পূর্ণ ভরসার এক বিরল উদাহরণ শৈশব থেকেই ফুটে ওঠে। তাঁর এই অবিচল বিশ্বাস ও খোদায়ী সাহায্যের প্রতিফলন পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রতিটি কর্মকাণ্ডেই দেখা গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা-

মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. মাতা-পিতা ও চাচাদের কাছে খুব আদরের সন্তান ছিলেন। সকলের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও গ্রামবাংলার সরলমনা মানুষের স্নেহ-মমতায় তিনি বেড়ে উঠেন। আনন্দ-আহ্লাদের মাঝে নিজের অজান্তেই একদিন তিনি লেখাপড়া করার মতো বয়সে উপনীত হন। তখন তাঁর শ্রদ্ধেয় বাবা বালক রহমতুল্লাহ’র লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় বাবা মরহুম মৌলভী ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের কাছে। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার কাছেই তিনি শিক্ষালাভ করেন। তখন তাঁর বাবা মৌলভী ওয়ালিউল্লাহ রহ., ঢাকার ধামরাই থানার বড়জেঠাই গ্রামে এক জামে মসজিদে ইমাম হিসেবে দীনি খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৫১ সালে তাঁর বাবা ইন্তেকাল করলে ১২ বছর বয়সেই তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন। বাবার ইন্তেকালের পর তিনি ধামরাই থেকে নিজ জেলা চাঁদপুরে চলে আসেন। ধামরাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। কুরআন শরীফ ও দীনের প্রাথমিক শিক্ষার কিতাবাদি তথা- উর্দু-ফার্সি ভাষায় ইত্যাদি বাবার নিকটই সমাপ্ত করেন। অতঃপর প্রসিদ্ধ দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জাফরাবাদ মাদরাসা’য় ভর্তি হন। এই মাদরাসায় তাঁর চাচাতো ভাই হজরত কারী বেলায়েত হুসাইন সাহেব রহ. শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. জামাআতে নাহবেমীর পর্যন্ত জাফরাবাদ মাদরাসায় লেখাপড়া করেন।

উচ্চশিক্ষা লাভ-

১৯৫৫ সনে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ঢাকার পথে যাত্রা করেন। সেখানে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগে’ ভর্তি হন। তখন লালবাগ মাদরাসায় উপমহাদেশের বড় বড় ইলমি ব্যক্তিত্বদের আনাগোনা হওয়ায় তা ইলমের মারকায এবং দেশসেরা মাদরাসা হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছিল। এ মাদরাসায় তখন হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি রহ.-এর খলিফা ও আস্থাভাজন তিনজন মনীষী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। একজন হাকীমুল উম্মত থানভি রহ. এর ভাগিনা ‘আহাদিসুল আহকাম’ সম্পর্কে লিখিত বৃহৎ কলেবরের বিখ্যাত কিতাব ‘ই’লাউস্ সুনান’ এর লেখক আল্লামা জাফর আহমাদ উসমানী রহ.। দ্বিতীয়জন সমাজ সংস্কারক মুজাহিদে আজম হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (ছদর সাহেব) রহ.। অপরজন ওলিয়ে কামেল হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) রহ.। তিনি এই মহামনীষীগণের কাছে নিজেকে সোপর্দ করেন। তাদের খেদমত ও সাহচর্য থেকে অধ্যয়ন করেন। আসাতিযায়ে কেরামের নেক নজর তার প্রতি প্রসারিত হওয়ার ফলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ১৯৬৫ সালে মেধা তালিকায় ১ম স্থান অধিকার করে দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) সমাপ্ত করেন।

উলুমুত তাফসির-

১৯৬৬ সনে মুরুব্বিদের দিকনির্দেশনায় লালবাগ মাদরাসায় ‘উলুমুত তাফসির’ বিভাগে ভর্তি হন। এক বছরকাল বিভিন্ন তাফসির গ্রন্থের উচ্চতর কিতাবাদি অধ্যয়ন করেন। সেই সঙ্গে দরসে নেজামির পাঠ্য সকল বিষয়ের ওপর বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন।

হাদিসের আসাতিযায়ে কেরাম-

  • আল্লামা জাফর আহমাদ উসমানী রহ.
  • আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (ছদর সাহেব হুজুর) রহ.
  • হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ (হাফেজ্জী হুজুর) রহ.
  • আল্লামা হিদায়াতুল্লাহ (মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর) রহ.
  • শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ.
  • মুফতি হারুন রহ.
  • মুফতি দীন মুহাম্মাদ রহ.
  • মুফতি আবদুল মুঈয রহ.
  • হাফেজ মাওলানা আব্দুল কবীর রহ.
  • মাওলানা আবদুল মাজিদ (ঢাকুবী হুজুর) রহ.
  • মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব রহ.।

ছাত্রজীবনের বৈশিষ্ট্য-

ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী মনোযোগী ও নেক স্বভাবের ছাত্র ছিলেন মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ.। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘুরাফেরা করা কিংবা অযথাই সময় নষ্ট করা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ কাজ ছিল। ইলম ও আমলের একাগ্রতাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।

আসাতিযা ও উলামাদের প্রতি ইহতিরাম-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. আসাতিযায়ে কেরামের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের যেকোনো নির্দেশ পালন করাকে নিজ দায়িত্ব মনে করতেন। যে সকল উস্তাদের নিকট তিনি মক্তব বা প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছেন এককালে তিনি মস্তবড় আলেম হওয়া সত্ত্বেও তাদের সামনে সব সময় দৃষ্টি অবনত রাখতেন। মনে হতো এখনও তিনি যেন তাদের মকতবের ছাত্র। তিনি একথা বলতেনও যে, আসাতিযায়ে কেরামের হক সবচেয়ে বেশি। তিনি আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতসমূহের মাঝে ইলমকে সবচেয়ে বড় নেয়ামত মনে করতেন। ইলমের ওপর অন্যকিছুকে তিনি প্রাধান্য দিতেন না। তাঁর উস্তাদদের কথা ও দেখানো পথে আমৃত্যু জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি দেশের সর্বশ্রেণির উলামায়ে কেরামকে ইহতিরাম করতেন।

কর্মজীবন-

লেখাপড়া সমাপ্তির পরপরই তিনি ১৯৬৬ ঈসায়ি সনে রমজান মাসে হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সঙ্গে ইতিকাফ করেন। এতে তার ইলমি ও আমলি অনেক উন্নতি হয়। রমজানের পর হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাঁকে মাদরাসায়ে নূরিয়া কামরাঙ্গীরচরের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। তখন মাদরাসাটি ‘কাফিয়া জামাআত’ পর্যন্ত ছিল। প্রথম সাময়িক পরীক্ষা পর্যন্ত তিনি জামাআতে কাফিয়ার ছাত্রদেরকে একাই সকল কিতাব দরস প্রদান করেন। সেখানে একবছর শিক্ষকতার পর হজরত শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. এর পক্ষ থেকে একটি পত্র আসে। পত্র পাঠ করে তিনি জানতে পারেন, তখন খুলনার (বর্তমান গোপালগঞ্জ) গওহরডাঙ্গা মাদরাসার জন্য একজন ‘মুহাদ্দিস’ আবশ্যক। হজরত ফরিদপুরী রহ. তাকে সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তখন মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. গওহরডাঙ্গা মাদরাসায় যান। এবং মুহাদ্দিস হিসেবে অধ্যাপনায় অংশ নেন। সেখানে তিনি সুনানে আবু দাউদ, তাফসিরে বায়জাবী, হেদায়া, শরহে তাহজিব, কাফিয়া’র মতো জটিল কিতাবসমূহের দরস প্রদান করেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে ছয় বছর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন।

হজরত ছদর সাহেব রহ. তাকে অনেক ভালোবাসতেন। হজরতের সঙ্গে তার সম্পর্ক এতো গাঢ় ছিল যে, হজরত নিজে তার খোঁজ-খবর নিতেন। তাই তিনি প্রায় সময় হজরত ছদর সাহেব রহ.-এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলতেন, ‘ছদর সাহেব রহ. আমাকে বে-ইস্তেহা মুহাব্বাত করতেন, তার কাছে আমি এতো স্নেহ-মমতা পেয়েছি যে, সম্ভবত আমার বাবা-মায়ের কাছেও অতটা স্নেহ পাইনি।’

১৯৬৮ সনের শুরুর দিকে হজরত ছদর সাহেব রহ. ইন্তেকাল করেন। এতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। এদিকে খুলনা আলিয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে তাকে আহ্বান জানানো হয়। তিনি তাতে সাড়া দিয়ে সেখানে চলে যান। দুই বছর সেখানে হাদিসের খেদমত করার পর দেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে তিনি সেখানে কিছুদিন কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেন।

তাঁর ছাত্রবৃন্দ-

তার শিক্ষার অবদান নূরানী পদ্ধতিতে তা’লীমুল কুরআনের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক আলেম-উলামা মাদরাসার ছাত্র-উস্তাদ তাঁর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কেননা নূরানী শিক্ষা বলতে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে দুই ব্যক্তির নূরানী শিক্ষা সিলেবাস প্রচলিত। কারী মাওলানা বেলায়েত হুসাইন সাহেব রহ. ও কারী মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ. প্রণীত নূরানী শিক্ষা সিলেবাস। আর বলাবাহুল্য যে সবাই নূরানী শিক্ষা সমাপন করেই দীনি ধারার উচ্চশিক্ষার পথে অগ্রসর হন। তবুও সরাসরি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে উপকৃত হয়েছেন; (চাই তা তার দরসে নেযামীতে পড়ানো অবস্থায় হোক বা নূরানী পড়ানোর অবস্থায় হোক;) বর্তমানে বিখ্যাতজনদের মধ্যে এঁদের সংখ্যাও কম নয়।

বিবাহ-

দাম্পত্য মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রয়োজনের তাগিদেই বিয়ে-শাদির ব্যবস্থা চলে আসছে সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে। পৃথিবীতে যত নবী-ওলী ও বুজুর্গানে দীন অতিবাহিত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই দীনি প্রয়োজনেই দাম্পত্য জীবনে পা রেখেছেন। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে এটাও একটি ইবাদত।

চাঁদপুর জেলার উজানী থানার প্রসিদ্ধ বুজুর্গ কারী ইবরাহীম সাহেব রহ.- এর সুযোগ্য খলিফা ছিলেন কারী সবর আলী রহ.। তার সুযোগ্য সন্তান মাওলানা কারী সফিউল্লাহ সাহেব রহ.। যিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘জামিআ ইউনুসিয়া’য় দীর্ঘদিন যাবত নাহু-ছরফের ইমাম হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তারই দ্বিতীয় কন্যা মুহতারামা মুবাশশিরা খাতুনের সঙ্গে ১৯৬৭ ঈসায়ি সনে মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. এর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। এর ক’বছর পর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর তিন বছর ফরিদপুরের একটি মাদরাসায় অধ্যাপনার খেদমত আঞ্জাম দেন। তারপর তাঁর জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। আল্লাহ তাআলা তাকে পবিত্র কুরআনের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে কবুল করেন। তাঁর চাচাতো ভাই কারী বেলায়েত হুসাইন সাহেব রহ. তাকে এই খেদমতে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে কাণ্ডারীর ভূমিকা পালন করেন। তিনি কুরআনুল কারীম শিক্ষাদান সহজীকরণে নূরানী পদ্ধতির আবিস্কার করেন। তাঁর দক্ষ দিক-নির্দেশনায় মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. নিজেকে কুরআনের খেদমতে নিয়োজিত করেন। অতঃপর ১৯৭৪ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বিরামহীনভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে কুরআন শিক্ষার খেদমত করে গিয়েছেন।

অবদান-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. এর দ্বারা মহান আল্লাহ এদেশে কুরআন ও দীনের অসংখ্য খিদমত নিয়েছেন। ‘নূরানী তা’লীমুল কুরআন ওয়াক্ফ্ফ এস্টেট’ ও ‘জামিআ নূরানীয়া তারাপাশা, কিশোরগঞ্জ’ তাঁর নিরলস খেদমতের ফসল। তাঁর নিমগ্ন খেদমতের কারণে যখন তাঁর সুনাম সুখ্যাতি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনো তাঁরমধ্যে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার ধন-দৌলত ও চাকচিক্যের প্রতি মোহ জায়গা করে নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়; এগুলোর প্রতি যেন তাঁর সামান্য পরিমাণেও টান অনুভূত না হয় এবং কারো যেন তাঁর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় বা কুধারণা সৃষ্টি না হয়, সেজন্য তিনি জীবনে কোন প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ ও লেনদেনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেননি। এবং চোখের সামনে তাঁর জানামতে কোথাও এক পয়সার খেয়ানত হতে দেননি।

শিক্ষাদানের বৈশিষ্ট্য-

তিনি যেকোন বিষয়কে সহজ সুন্দরভাবে ছাত্রদের সামনে এমনভাবে তুলে ধরতেন যে, প্রত্যেক ছাত্রই বিষয়টি অতি সহজে বুঝে ফেলতো। তিনি বিষয়কে অতি দীর্ঘায়িত করতেন না। আবার অতি সংক্ষিপ্তও করতেন না। মধ্যম পর্যায়ের আলোচনার দ্বারা বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতেন। সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতেন। যে কারণে ছাত্ররা তাঁর কাছে পড়ার জন্য প্রবল আগ্রহী থাকতো। তাঁর ছাত্রদের বক্তব্য- তিনি ইলমের সাগর ছিলেন। যার গভীরতা উপলব্ধি করা যেতো না। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি ছিল খুবই উচ্চাঙ্গের। প্রথমে তিনি মূল বিষয়টি সহজ সুন্দরভাবে বুঝিয়ে পরে কিতাবের ইবারতের সঙ্গে তা মিলিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। সবক পড়ানোর সময়ও গাম্ভীর্যবজায় রেখে পড়াতেন। প্রয়োজনছাড়া কোনো আলোচনা করতেন না।

দরস দেওয়ার সময় তিনি ছাত্রদেরকে আমলের প্রতি উৎসাহ দিতেন। যে কারণে ছাত্রদের মাঝে ইলমের সঙ্গে আমলের আগ্রহ সৃষ্টি হতো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা আলেম উলামাদের মুআল্লিম প্রশিক্ষণেও একইভাবে খুব সহজ কার্যপ্রণালীর মাধ্যমে অতি সহজে কুরআন সহি-শুদ্ধ করার ব্যাপারে তালিম দিতেন। কুরআন শিক্ষাদানের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা করতেন।

ছাত্রদের প্রতি স্নেহ-মমতা-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. স্বভাবগতভাবেই অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। ছাত্রদের প্রতি খুবই স্নেহশীল ছিলেন। যে কারণে ছাত্ররা তাঁর প্রতি অসম্ভব মুহাব্বাত রাখতেন। ছাত্রদের প্রাণের অভিভাবক ছিলেন তিনি। দারিদ্রের কারণে যে সব ছাত্র খাওয়া-পড়ার কষ্ট করত তিনি তাদের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখতেন। কোন ছাত্রকে প্রহার করতেন না। এমন কি কড়া ভাষায় ধমকও দিতেন না। তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বেত্রাঘাত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।

ছাত্র অন্তঃপ্রাণ এই দরদি শিক্ষকের স্নেহ, মায়া-মমতা আর ভালোবাসার ফসল হিসেবে দেশের আনাচে-কানাছে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার আলেম, হাফেজ ও কারি। তিনি ছিলেন আলোকিত এক সমাজের দিকপাল।

কুরআন শিক্ষার প্রতি অনুরাগ-

কুরআন শরীফ শিক্ষা করা মানুষের প্রতি আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠতম রহমত এতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই। এ শিক্ষা মানুষকে আল্লাহর পরিচয় দান করে, মানুষকে আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ দেখায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তষ্টি সম্পর্কে অবগত করে। এ শিক্ষায় মানুষের অর্ন্তদৃষ্টি খুলে যায় ও তার জ্ঞান-গবেষণায় উৎসাহ যোগায়। এ শিক্ষা মানুষের অন্তরে পাপ-পুণ্যের বোধ জাগ্রত করে ও ন্যায়-অন্যায় বিচারের প্রেরণা দেয়। কুরআনের শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা, যা মানুষের ইহজীবনকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এর দ্বারা পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি, ভাই-বোন, স্বামী- স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীসহ সর্বস্তরের মানুষের অধিকার জানা যায় এবং এ শিক্ষা মানুষকে সে অধিকার আদায়ে সচেতনতা দান করে। তা মানুষের অন্তরে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল করে দেয় যে, অন্যের অধিকার আদায় সম্পর্কে প্রত্যেককে কিয়ামতের দিন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।

এ ভাবনাকে সামনে রেখে মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ. শিশু ও বয়স্কদের কুরআন শিক্ষার সহজ পদ্ধতি আবিস্কার করে কুরআনের শিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিবেদিত করেন। তিনি হাজার হাজার আলেমের ওস্তাদ ছিলেন। কুরআন শিক্ষায় নিবেদিত উজ্জ্বল বর্ণের মানুষটির জীবন ত্যাগ ও সাধনার। দুনিয়াবিমুখ এই মনীষীর জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের দ্যুতি ছিল তাঁর জীবনের কর্মশক্তি।

ইলমে নববীকে তিনি আল্লাহ্ প্রদত্ত সবচেয়ে বড় নেয়ামত মনে করতেন। তাই ইলমে দীনকে সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিতেন। তিনি সম্পদ ও অর্থের দিকে কখনও খেয়াল করেন নি। শহরে তো নয়ই, গ্রামেও মাধ্যম মানের একটি বসতভিটা তৈরি করার চিন্তা করেননি। অথচ সামান্য খেয়াল করলেই তখন শহরে বাড়িঘর করা তার জন্য কঠিন ছিলো না। ছাত্রদেরকে বিশেষভাবে শিক্ষা উত্তীর্ণ ছাত্রদেরকে ইলমের খেদমত ও দীনি মাদারিস প্রতিষ্ঠার দিকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন।

তিনি মনে প্রাণে কামনা করতেন তার খান্দানের ও এলাকার প্রতিটি ঘরের সন্তানেরা ইলম শিখে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের অধিকারী হোক। তার অন্তরের এই আবেদনের কারণেই পুরো এলাকায় কমবেশী অনেক হাফেজ ও আলেমে দীন তৈরি হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন।

কিশোরগঞ্জ আগমন, ‘মাদরাসায়ে বাগে জান্নাত’ ও ‘জামিআ নূরানীয়া তারাপাশা মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা-

কিশোরগঞ্জবাসী যেসকল বুজুর্গের মেহনতের বদৌলতে দীনি শিক্ষা পেয়েছে, হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৯৭৭ সালে আলহাজ মুফিজুদ্দীনসহ কিছু দীনদার মানুষ কারী বেলায়েত সাহেব রহ.-এর কাছে আবেদন করলেন, যেন তিনি কুরআন শিক্ষার বয়স্ক ক্লাসের জন্য কিশোরগঞ্জে একজন অভিজ্ঞ মুআল্লিম প্রেরণ করেন। সেসময় বেলায়েত সাহেব রহ. কারী মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ.-কে পাঠান। তিনি তার নির্দেশে কিশোরগঞ্জ এসে জোর মেহনত শুরু করেন। অল্পদিনে তার মেহনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ কুরআন শিক্ষার জন্য ছুটে আসতে থাকে।

একপর্যায়ে ১৯৭৮ সালে তিনি ঐতিহাসিক ‘শোলাকিয়া মাঠে’র উত্তর পাশে ‘মাদরাসায়ে নূরিয়া বাগে জান্নাত’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। হজরতের নূরানীর খেদমতের সুফলে যা আজ নূরানী মাদরাসা নামে প্রসিদ্ধ। অল্পদিনের মধ্যে এই মাদরাসার সুনাম সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কিছু কুচক্রীদের লোভনীয় দৃষ্টিতে পড়তে হয়। যেকারণে এই মাদরাসার সুনাম ও পড়ার মান বেশিদিন স্থায়ী হয়নি বড় হুজুর রহ.-এর চলে আসায়। কিছু দুঃখজনক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়।

সালামবাগ জামে মসজিদে ইমামতি-

মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. কিশোরগঞ্জ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার রামপুরা সালামবাগ জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি যেহেতু কুরআন প্রেমিক ছিলেন, তাই কেবল ইমামতিতে স্থির হননি; বরং সেখানে নূরানী পদ্ধতিতে কুরআন শিক্ষার একটি ক্লাস খুললেন। সেখানে তার ক্লাসে অনেক মানুষ কুরআন শিক্ষার জন্য অংশগ্রহণ করেন। যদ্দরুন তা এক কুরআন শিক্ষার মারকাজে পরিণত হয়।

পুনরায় কিশোরগঞ্জ আগমন ও জামিআ নূরানিয়া প্রতিষ্ঠা-

Screenshot 2

ঢাকায় কিছুদিন অবস্থানের পর কিশোরগঞ্জের তারাপাশা (বয়লা) এলাকার আলহাজ্ব মতিউর রহমানসহ কিছু দীনদার লোকের আবদার রক্ষার্থে পুনরায় তিনি কিশোরগঞ্জে আগমন করেন। এ সময় আলহাজ মরহুম মতিউর রহমান সাহেব তাকে সাড়ে ‘৫২’ শতাংশ জায়গা ‘কুরআন শিক্ষার একটি মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন। কুরআন অনুরাগীদের আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখে তিনি বৃহদাকারে একটি মাদরাসা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাই মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের লক্ষ্যে উস্তাদ মাওলানা বেলায়েত সাহেব রহ. সহ গণ্যমান্য মুরুব্বিদেরকে দাওয়াত করেন। হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-ও আসতে সম্মতি জানান। ১৯৮২ সনের ২২ অক্টোবর এ মাদরাসার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তখন এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নূরানী মাদরাসা ও ট্রেনিং সেন্টার’। হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.-এর কঠোর শ্রম-সাধনা আর ইখলাসের বদৌলতে মাত্র কয়েক বছরেই মাদরাসাটির সুনাম-সুখ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় হাজারো ছাত্রের সমাগম হয় এ মাদরাসায়। ফলে ২০১১ সালে তা ‘জামিআ নূরানীয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০১৫ সালে দাওরায়ে হাদিস (তাকমীল) এর মুবারক দরস শুরু হয়।

‘নূরানী তা’লীমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেট’ প্রতিষ্ঠা-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকেই কারী মাওলানা বেলায়েত সাহেব রহ.-এর সঙ্গে কুরআন কারিমের ‘নূরানী পদ্ধতি’র মিশন নিয়ে সম্পৃক্ত হন। তখন মুরুব্বীগণ উক্ত পদ্ধতির প্রচার-প্রসারের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.-এর ‘নূরানী পদ্ধতিতে অল্পসময়ে কুরআন শিক্ষা’র বয়স্ক ক্লাসের ছাত্র ছিলেন আলহাজ আবদুল মালেক সাহেব রহ.। হাজী সাহেব রহ. ছিলেন দীন দরদী মানুষ। আল্লাহ তাআলা তাকে যেমন টাকাপয়সা দিয়েছিলেন; সেগুলোকে দীনের পথে খরচ করার মতো সাহসী হৃদয়ও দান করেছিলেন। তাই তিনি বাংলাদেশের অনেক বড় বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় দু’হাত খুলে অকাতরে দান করে গিয়েছেন। তিনি মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেবে’র সবকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পবিত্র কুরআন শিক্ষার খেদমতের জন্য তার কিছু সম্পত্তি ওয়াক্ফ্ফ করে দেন। ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ আবদুল মালেক সাহেব রহ.-এর প্রস্তাবে তখন তার ওয়াকফকৃত সম্পত্তির ওপর ‘নূরানী পদ্ধতিতে কুরআনুল কারিমের খেদমতে’র জন্য ১৯৮৪ সালে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। যা ‘নূরানী তা’লীমুল কুরআন ওয়াক্ফ এস্টেট’ নামে সুপ্রসিদ্ধ। শুরুর দিকে নূরানী তালিমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুরব্বী হিসেবে কারী বেলায়েত সাহেব রহ. ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬/৮৭ সালে মুতাওয়াল্লী কমিটির সঙ্গে হজরত মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. এর দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় তিনি ‘ওয়াক্ফ এস্টেট’ থেকে চলে যান। ফলে উক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার পড়ে মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেবের ওপর।

রঈসুল মুআল্লিমীন নূরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ড প্রতিষ্ঠা-

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মালেক সাহেব রহ.-এর ইন্তেকাল হয় ২০০২ সালে। তাঁর ইন্তেকালের পরও মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ‘নূরানী তা’লীমুল কুরআন ওয়াক্ফ এস্টেট‘ পরিচালনা করে যাচ্ছিলেন। হাজী সাহেবের মৃত্যুর পর মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তার ছেলে ডা. আব্দুল কাইয়ুম সাহেবের ওপর। চূড়ান্ত বার্ধক্যে এসে ২০১৫ সালের শেষের দিকে তাঁকে সেখান থেকে চলে আসতে হয়। এতে তিনি অনেক ব্যথিত হন। কুরআনের খাদেম হিসেবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য তিনি সেখান থেকে এসে ‘বাংলাদেশ নূরানী তা’লীমুল কুরআন’ নামে নূরানীর আরেকটি ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার পুরুষ ও মহিলা শাখা উভয়টিই রয়েছে। রাজধানীর ঢাকা উদ্যানে এর স্থায়ী অফিস অবস্থিত।

রচনাবলী-

লেখালেখির প্রতি তাঁর বেশ অনুরাগ ছিল। তাই তিনি কুরআন শিক্ষা বিষয়ক কিছু বই তিনি রচনা করেছেন। যা সবার কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে।

  • পবিত্র কুরআন ও দীন শিক্ষার নূরানী পদ্ধতি (দুই খণ্ডে সমাপ্ত)
  • নূরানী পদ্ধতিতে অল্পদিনে কুরআন শিক্ষা
  • সহজ নূরানী কায়দা
  • মাতৃজাতির মর্যাদা ও অধিকার
  • ফাযায়েলে কুরআন (অপ্রকাশিত)
  • জীবনের পণ

ধৈর্য ও সহনশীলতা-

ধৈর্য ও সহনশীলতা ছিল তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের শুরু হতেই বহু ঘাত প্রতিঘাত তিনি মোকাবেলা করেছেন অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে। কষ্ট ও সংকটের সময় কেবলই আল্লাহর কাছে এ থেকে উত্তরণের ফরিয়াদ জানাতেন; কিন্তু মুখ ফুটে কারো কাছে তার অভিযোগ করতেন না। দু’দিন উপোস থাকলেও না।

আত্মশুদ্ধি-

ছাত্র জীবনেই বুজুর্গানে দীনের ইসলাহি মজলিসে বিশেষভাবে হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী রহ.-এর মজলিসে বসেছেনে। পরবর্তী সময় হাকীমুল উম্মত হজরত থানভি রহ.-এর সর্বশেষ খলিফা হজরত হারদুয়ী রহ.-এর হাতে বায়আত হয়ে বিভিন্ন সময় মজলিসে হাজির হতেন।

বায়আত ও খিলাফত-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছাত্রজীবনেই আত্মশুদ্ধির জন্য শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. ও হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কাছে নিজেকে সঁপে দেন। হজরত ছদর সাহেব রহ.-এর সোহবতে ১২ বছর এবং হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.-এর সোহবতে প্রায় ৩০ বছর অতিবাহিত করেন। এই ত্রিশ বছর তিনি নিয়মিত হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইতিকাফ করেন। অতঃপর হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সঙ্গে পুনর্বার এই শর্তে বায়আত হন যে, ‘একজন অপরজনকে ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবেন না’। এমনিভাবে হজরত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন- হে আজিজুল হক! তুমি আমার জন্য কী নিয়ে এসেছ? তখন আমি আল্লাহর দরবারে রহমতুল্লাহ ও মনসুরুল হককে পেশ করে বলবো হে আল্লাহ। আমি এদেরকে গড়ে এনেছি!’

শরীয়তের পাবন্দী-

মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ. ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনে খুব পরিচ্ছন্ন জীবনের অধিকারী। আমল-আখলাক, মুআমালাত-মুআশারাত ও আদর্শবাদিতার ক্ষেত্রে তাঁর উপমা খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর ব্যাপার। সকল ক্ষেত্রে সুন্নতে নববীর অনুসরণ ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খাওয়া-দাওয়া, উঠা-বসা, জাগরণ-নিদ্রা সব ক্ষেত্রেই যেন সুন্নতে মুতাহহারা শোভা পায় এটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। শরীয়তের বাইরে কোন কাজ নিজে করা তো দূরের কথা কাউকে করতেও দিতেন না। এমনকি এজন্য জীবনে বড় ধরনের অর্থনৈতিক কোন ধকল নেমে আসলেও নয়। তিনি প্রায় সময় একথা বলতেন, ‘শরীয়তের হুকুম জলাঞ্জলী দিয়ে দুনিয়া রক্ষা করা আমি পছন্দ করিনা।’

ইখলাস ও অল্পেতুষ্টির নমুনা-

ইখলাস ছিল হজরত বড় হুজুর রহ.-এর জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইবাদত-আমল, সমন্বিত কাজ, আচরণ সব ক্ষেত্রে তাঁর ইখলাসের ধরনটাই এমন ছিল যে, তা টের পাওয়া যেত, উপলব্ধি করা যেত। ইখলাস একান্তই অন্তর্গত একটি স্বভাব ও আমল। বাহ্যিকভাবে তার অনুভব করাটা অত্যন্ত দুরূহ ও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে ইখলাসের লালন ও প্রকাশ এত সুন্দর হও হৃদয়গ্রাহী হতো যে, উপস্থিত অন্যরা সেটা টের পায়। কোনো লৌকিকতা তিনি পছন্দ করতেন না। আর্থিক অস্বচ্ছলতার সময় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। এই তিন বছর কেবল তিনি ‘জামিআ নূরানীয়া’ থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছিলেন। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জামিআ থেকে কোনো বেতন-ভাতা গ্রহণ করেননি। তবে ১৯৮৪ সালে ‘নূরানী তা’লীমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেট’ গঠন হওয়ার পর সেখান থেকে বেতনভাতা প্রাপ্ত হন। তিনি নিজকে খুব ছোট মনে করতেন। তাঁর বিভিন্ন সময়ের আচরণে সেসব বিষয় ফুটে উঠতো। একবার মিরপুর দারুস সালাম মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা আব্দুল হাকীম কাসেমী সাহেব দা.বা. তাঁকে দেখতে কিশোরগঞ্জ গেলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান। তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘মু’আইদীকে (তার সাহিত্য প্রতিভার কারণে মুগ্ধ হয়ে) দেখতে আসার চেয়ে তার কবিতা- সাহিত্য শুনে খুশি থাকা উত্তম। কেননা তার সাহিত্য হৃদয়গ্রাহী ছিল বটে; কিন্তু তার চেহারা সূরত ছিল কদাকার-বিশ্রী। আমিও হলাম সেই মু’আইদী। লোকেরা আমার নাম যশ শুনে দূর থেকে আমাকে দেখতে আসে; কিন্তু আমার মধ্যে তো কিছুই নাই।’

তাকওয়া ও পরহেজগারী-

মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ. ছিলেন তাকওয়ার ক্ষেত্রে বেনজির এক ব্যক্তিত্ব। সময়মত জামাআতের সঙ্গে নামাজ পড়া এবং তাহাজ্জুদ গুজারীতে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক ও সজাগ। শেষ জীবনের ক’মাস অসুস্থতা আর রোগের যাতনায় পৃথিবীতে অন্য সবকিছু ভুলে গেলেও নামাজ ও তাহাজ্জুদের কথা তিনি ভুলতেন না। অসুস্থতার সময়টায় তিনি এতটাই অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন যে, একা একা উঠে বসা তো দূরের কথা এপাশ ওপাশও করতে পারতেন না। পেশাব পায়খানা থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রেই অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। এমন মুমূর্ষ অবস্থা হলেও একটু পরপরই জিজ্ঞেস করতেন, নামাজের সময় হয়েছে কি? সময় হলে আমাকে উঠাও, নামাজ পড়াও।

আখলাক-

হজরত বড় হুজুর রহ.-এর স্বাভাবিক আচরণ ছিল কোমল ও উদার। মাঝে মাঝে তিনি কোনো বিষয়ে কঠোর হতেন। তিনি ব্যক্তিগত কোনো কারণে কারও প্রতি কঠোর হতেন না। দীনের খাতিরেই তা হতেন। সাধারণত তিনি ছিলেন সহজ সরল। কুটিল কোনো চিন্তা তাঁর মধ্যে ছিল না। সবাই তাঁর সঙ্গে সহজেই মিশতে পারতেন। কোমল ব্যবহার করতেন সবার সঙ্গে। সামাজিক সৌজন্য বোধ ছিল বিশেষ পর্যায়ে।

খুলুকে হাসানার যাবতীয় গুণাবলী-ই তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। হাদিস শরীফে এসেছে, তোমাদের মাঝে সেই উত্তম যে, নিজ পরিবার-পরিজনের নিকট উত্তম অতএব, চরিত্র মাধুর্যের ক্ষেত্রে আপনজনদের স্বীকৃতি ও উক্তিই হল সবচেয়ে বেশী গ্রহণযোগ্য। মরহুমের আখলাক ও আমলের সবচেয়ে বেশী প্রশংসা করে থাকেন তার আহলিয়া। তাছাড়া নিজের একান্ত জন, আত্মীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এলাকাবাসী, কর্মস্থলের সাথীবৃন্দ, আসাতিযা, তালামিযা, সকলেই একবাক্যে মরহুমের চরিত্র- মাধুর্যের উচ্চ প্রশংসা করে থাকেন। কটু কথা বা করো মনে আঘাত আসতে পারে এমন কথা কখনও তার থেকে শোনা যায়নি।

তিনি ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। একাধারে দীর্ঘ বছর কাল তিনি নূরানী তালিমুল কুরআন ওয়াকফ এস্টেটের সম্মানিত মহাপরিচালক ছিলেন। সারাদেশব্যাপী কয়েক লক্ষ মুআল্লিমদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। সর্বোচ্চ মর্যাদা এবং ভালোবাসায় সিক্ত হতেন। এ দীর্ঘ সময়ের মাঝে যে কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি তা নয়; বরং একাধিকবার ভিতর ও বাহির থেকে প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রতিবারই তাঁর ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা, ন্যায় পরায়ণতা, নিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সততা ও সংযমের কারণে খোদায়ী মদদ তাঁর পক্ষে থেকেছে।

সুন্নতের মূর্ত প্রতীক

ফেরেশতাতুল্য শুভ্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, ধার্মিক, বিনয়ী ও অসংখ্য মহৎগুণের অধিকারী। তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন বা তাঁর সোহবতে ছিলেন তাদের বক্তব্য হলো, সহজ-সরল অথচ সমাজ সচেতন একজন গুণী লোক ছিলেন তিনি। কাউকে কষ্ট দেওয়া কিংবা কারও বিরুদ্ধে কূটকৌশল অবলম্বন করার কথা তাঁর ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না। জীবনে বহু মানুষের কাছে ঠকেছেন, কিন্তু অন্যকে ঠকানোর নজির কেউ দেখাতে পারবে না। নিজের ঘনিষ্ঠ ও স্বগোত্রীয় অনেকেই তাঁর সঙ্গে শত্রুতা দেখিয়েছে, কিন্তু তিনি জীবনে কারও সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করেননি।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সা.-এর সুন্নতের পুরো পাবন্দ ছিলেন তিনি। গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাটাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু। আমরা যতটুকু দেখেছি বা শুনেছি তাতে খেলাফে সুন্নত কোনকিছু করতে তাঁকে কখনও দেখা যায়নি। এমনিভাবে ছোট বড় কোন ধরনের গোনাহের কাজ করতেও কেউ কোনদিন দেখেনি।

নির্লোভ জীবন সাধনা-

অর্থের প্রতি লোভ বা দুনিয়ার পেছনে দৌড়ানো তিনি কখনই পছন্দ করতেন না। প্রায় সময়ই তিনি বলতেন- তুমি যদি সর্বদা দুনিয়ার পেছনে ছুটে বেড়াও, তবে দুনিয়া তোমার থেকে দূরে সরে যাবেই। আর না পাওয়ার এক যাতনা তোমাকে কুড়ে কুড়ে খাবে। আর তুমি যদি আদর্শবাদী হও তবে নির্ধারিত রিজিক তোমার কাছে পৌছে যাবেই, তাতে কোন সন্দেহ নেই। নূরানী ওয়াকফ এস্টেটের সম্মানিত মুতাওয়াল্লী হাজি আবদুল মালেক সাহেব রহ, বলতেন- ঢাকায় আপনার স্থায়ী বসবাসের জন্য কিছু করার দরকার। আপনি আপনার পছন্দ মতো একটা বাড়ি কিনে নিন। আমি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবো। না দিলেও কোন আপত্তি থাকবে না। উত্তরে তিনি বলতেন, ‘শহরের বিলাসী জীবনের ইচ্ছা আমার নাই। সন্তানগুলোকে দীনের লাইনে মানুষ করাতে চেষ্টা করছি। দোয়া করবেন যাতে সফল হই। এর বাইরে বাড়ি-গাড়ির কেনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।’

হারামাইন সফর-

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য সহি কিতাবসহ নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন এবং নবী-রাসুলের আগমনের স্পষ্ট প্রমাণের জন্য তাঁদের মাধ্যমে কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্মৃতি বহন করে চলবে। তার মধ্যে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর অন্যতম। এটিকে আল্লাহ নিজের ঘর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘ইত্তাখাযাল্লাহু বাইতান ফিদ্দুনিয়া’ এটি মুসলিম জাতির জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত।

কাবা শরীফের যিয়ারত একজন মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আল্লাহ সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন- ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এই ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’ এ ঘরটিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কুরআনের শুরুতে যেমন ‘লা-রাইবা’ শব্দ দিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তেমনি এখানেও নিঃসন্দেহে শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন একজন খাঁটি আল্লাহর ওলী। আল্লাহর ঘর এখনো যে তিনি দেখেননি। তাঁর হৃদয়ের ব্যাকুলতা হলো, আহা, একবার যদি দেখতে পেতাম আমার মাওলার ঘর! একবার যে দেখে তার ব্যাকুলতা হলো, আহা, আবার যদি দেখতে পেতাম আমার আল্লাহর ঘর! তাই বাইতুল্লায় হাজির হওয়ার জন্য তার হৃদয় মন অস্থির হয়ে থাকতো। অবশেষে আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমতে ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে পরপর দু’বার বাইতুল্লাহ্র মেহমান হয়ে হজ পালন করে মনের তৃপ্তি মেটান। প্রথমবারের হজের সফরে জান্নাতুল বাকীতে বসে তিনি ‘ফাযায়েলে কুরআন’ নামক একটি কিতাব রচনা করেন। কিন্তু তা সফরেই হাতছাড়া হয়ে যায়।

দাওয়াত ও তাবলীগ-

দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানেও তার বিশেষ পদচারণা রয়েছে। ইলমি খেদমত তথা কুরআন শিক্ষা ও মাদরাসা পরিচালনার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় তাফসির করা সহ সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে দীনের বাণী পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের নামে যে মেহনত চলছে বিশ্বময়। সেই মহান কাজেও তিনি অংশগ্রহণ করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সনে ভারত সফর করেন। ৪০ দিন সেখানে অবস্থান করে দাওয়াতের মেহনত করেন।

সামাজিক জীবন-

সামাজিক জীবনে তিনি ছিলেন সহমর্মী ও উদার নীতির অনুসারী। সামাজিক কলহ বিবাদ ছিল তার নিকট অসহনীয়। কলহ বিবাদের পথকে তিনি সর্বদা পরিহার করে চলতেন। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে হলেও শান্তি -শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় রেখে চলতেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে ছিল তার আন্তরিকতা ও সৌহার্দের সম্পর্ক। এ কারণে সমাজের ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, উঁচু-নীচু সর্বস্তরের মানুষ তাকে মুহাব্বত ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখত। কিভাবে নবীজির সুন্নত জিন্দা হতে পারে, বিদআত ও কুসংস্কার কিভাবে অপসারণ করা যায় এক্ষেত্রে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন।

দৈহিক গঠনাকৃতি-

তিনি হাস্যোজ্জ্বল পৌরুষদ্বীপ্ত লাবণ্যময় চেহারার অধিকারী ছিলেন। দীর্ঘাকৃতির মানানসই সুঠাম দেহ ঘন শশ্রুমণ্ডিত প্রশস্ত বক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল ফর্সা। তাঁর ইলম, আমল-আখলাক সর্বোপরি সুন্দর সুঠাম দেহাবয়ব সব মিলিয়ে তিনি একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। প্রথম নজরেই তার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধায় অন্তর বিগলিত হয়ে যেত।

পারিবারিক জীবন-

তিনি নিজ গৃহে এবং আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করতেন। কখনও পরিবারের সদস্যদের প্রতি কঠোর আচরণ করতেন না। নিজ ঘরের কাজ অনেক সময় স্বহস্তে সম্পন্ন করতেন। ঘরে মহিলাদের কাজেও সহায়তা করতেন। পরিবারের সকলের খাওয়া পরার প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। ঘরে ভালো রান্নাবান্না হলে প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের ঘরে খাবার পাঠাতেন। তাদের খোঁজ-খবর নিতেন।

সন্তানাদি-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. কে আল্লাহ তাআলা তিনজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে সন্তান দান করেন। বড় ছেলে আবুল হাসান ছোট বয়সে ইন্তেকাল করে। অতঃপর দুই ছেলে দীনি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করে বর্তমানে দীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। আর চার মেয়ের সবাইকে তিনি আলেম স্বামীর কাছে বিয়ে দেন। তারাও সবাই দীনি খেদমতের সঙ্গে লেগে আছেন। মৃত্যুকালে তিনি তার সহধর্মিনী ও দুই ছেলে, চার মেয়ে রেখে যান। আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে তাঁর মৃত্যুর আগেই তিনি পরিবারের মধ্যে ১৮ জন হাফেজের মুখ দেখে যান।

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. ছিলেন একজন সফল বাবা। তাঁর সন্তানাদি সবাই তাঁর মুখ উজ্জ্বল করেছেন। চার মেয়েকে দীনি পরিবেশে শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে আলেম সুপাত্রের কাছে পাত্রস্থ করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় ছেলে তাঁর অবর্তমানে তাঁর হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান জামিআ নূরানীয়া তারাপাশা মাদরাসার সম্মানিত পরিচালক ও কিশোরগঞ্জের সর্বস্তরের আলেম উলামাদের আস্থার প্রতীক। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় চক্ষু শীতল করেছেন। তাঁর এই সাফল্যের পেছনে বড় কারণ হলো, তিনি সন্তানাদি পালনের যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেছেন। নিজে জাতিকে কুরআনের বিশুদ্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গিয়েছেন। দীনের কাজে উৎসর্গিত ছিলেন, কিন্তু সন্তানাদি ও পরিবারের প্রতি উদাসীন ছিলেন না। সন্তানদের সুযোগ্য ও যথার্থ দীনের একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে গড়ে তোলার আকুল চেষ্টা তাঁর মাঝে সবসময় ছিল। একদিকে তিনি প্রাণখুলে দোয়া করতেন সন্তানদের জন্য, শুধু নিজে দোয়া করেই ক্ষান্ত হতেন না, অন্য সবার কাছে নিজের অতি আদরের সাহেবজাদা মাওলানা আবুল বাশার সাহেবের জন্যও দোয়া চাইতেন। তাঁর ছেলেকে যোগ্য আলেম বানানোর পেছনে তাঁর চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তিনি নিজে সবসময় পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিতেন। এই ছেলের প্রতি তাঁর বিশেষ নজর ছিল। ছেলেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য হজরত জমিরউদ্দীন নানুপুরী রহ.-এর মতো ব্যক্তির খাস নেগরানি ও সোহবতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নানুপুরী হজরত তাঁর এই প্রিয় সন্তানকে খেলাফতও প্রদান করেন।

সন্তানদের প্রয়োজনের কথা তিনি সবসময় গুরুত্ব দিতেন। সন্তানদের প্রয়োজনীয় ও বৈধ আবদারও তিনি পূরণ করতেন, তবে কখনও তাদের প্রশ্রয় দিতেন না। প্রয়োজনে শাসনও করতেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা ও দোয়ার বরকতেই তাঁর পারিবারিক জীবন ছিল সুখময় ও কুরআনের আলোয় আলোকিত।

ইন্তেকাল-

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ, বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত এসে গেছে। মাওলা পাকের ডাক আসতে পারে যেকোনো সময়। তিনি প্রস্তুত মুসাফিরের মতোই সব সামানা গুছিয়ে বলা যায় একপ্রকার তিনি বসে রইলেন কখন আসবে তরি।

২০১৮ সালের জুন মাসের ১১ তারিখ নিজ বাসায় ব্রেইনস্ট্রোক করেন। কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। তাঁর শরীরের অবস্থা ভীষণ খারাপ হলে কর্তব্যরত ডাক্তারদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান থেকে ঢাকায় আগারগাঁও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ইন্তেকালের আগে দু’দিন দু’রাত তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। ১৪ তারিখ বৃহস্পতিবার মধ্যরাত। তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলো। অস্থিরতা বোধ করলেন।

রাত ১টা ৩৮ মিনিটে তাঁর শরীর ধীরে ধীরে বিছানায় ভার ছেড়ে দেয়। নিথর প্রাণের শরীর দুনিয়ার জীবনের শেষ তিনটি শ্বাস নেন। অল্লাহর প্রিয় বান্দা, আল্লাহর সঙ্গে গিয়ে মিলিত হলেন। ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

দিনটি ছিল ১৪ জুন ২০১৮, ২৮ রমজান ১৪৩৯ হিজরি বৃহস্পতিবার। ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

কাফন-দাফন ও জানাজা-

রঈসুল মুআল্লিমীন হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.-এর ইন্তেকালের পর মুহূর্তের মধ্যে এ সংবাদ পৌঁছে যায় দেশ-বিদেশে। সারা দেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। চারদিক থেকে তাঁর ভক্ত-মুআল্লিম ছুটে আসতে থাকেন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। রমজান মাসের শেষ এবং ঈদকে সামনে রেখে অনেকে ইতেকাফে থাকার কারণে আসতে পারেনি। তাঁদের হৃদয় ব্যথিত। নীরব নিস্তব্ধ শোকের বেদনা তাদেরকে মুষড়ে ফেলে। সবার চোখে মুখে স্বজন হারানোর বেদনা। নিজের ঘনিষ্ঠজন কেউ মারা গেলেও এমন শোকের স্তব্ধতায় কাতর হতে দেখা যায় না, যা দেখা গেছে মাওলানা রহমতুল্লাহ সাহেব রহ.-এর মৃত্যু সংবাদ শুনে ছুটে আসা লোকদের চোখে মুখে। সিদ্ধান্ত হয়, পরদিন জোহরের নামাজের পর জানাজা ও দাফন হবে। মোবাইলের কল্যাণে সারা দেশে এ সংবাদ পৌছে যায়। সারা দেশের নানা প্রান্ত থেকে লোকেরা জামিআ নূরানীয়া তারাপাশায় আসতে থাকল।

পূর্ব থেকেই কবরের জায়গা মসজিদ লাগোয়া নির্ধারণ করা ছিল। গোসল ও কাফন পরিয়ে আগে থেকেই লাশ তাঁর স্মৃতিবিজড়িত তারাপাশা জামিআর বিল্ডিংয়ের বারান্দায় ও পরবর্তীতে মাঠে এনে রাখা হয়। জোহরের নামাজের পর জানাজার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিতে থাকে। মাদরাসার বিশাল আঙিনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ধারণা করা হয়, কয়েক লাখ লোক এই জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সারা দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম এবং সর্বস্তরের মানুষেরা জানাজায় শরিক হন। জানাযাপূর্ব আবেগঘন বক্তৃতা করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম হজরত মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ.

হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. সারাদেশব্যাপী কুরআনের খেদমতের ফলে সব শ্রেণির মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছিলেন। এজন্য তাঁর ইন্তেকালের পর মানুষের মধ্যে ব্যাপক শোকের প্রকাশ ঘটেছে। অনেকেই চাপা শোকে দগ্ধ হয়েছেন। আলেমের মৃত্যু যে আলমের (জগতের) মৃত্যু এটা তাঁর ইন্তেকালে কিছুটা হলেও অনুভূত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে জাতীয় পত্র-পত্রিকায় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন সংগঠনের শোকবার্তা প্রকাশ হয়েছে। অনেকে তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর বিশেষ ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছেপেছে। দেশের নানা জায়গায় তাঁর স্মরণে আয়োজন করা হয়েছে স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিলের। একজন কুরআনপ্রেমী আলেমের ইন্তেকালে দেশব্যাপী শোকের এমন গভীর ছায়া নেমে আসতে সাধারণত দেখা যায় না। মূলত তিনি আল্লাহর কাছে মাকবুল হওয়ার পাশাপাশি মানুষের কাছেও ছিলেন স্মরণীয় ও বরণীয়।

তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে একটি বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি-

নিছক একটি জীবন নয়, ছিল কর্মময় একটি অধ্যায়। যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের সান্নিধ্য ও কুরআনের খেদমতে স্বতন্ত্রধারা সাফল্যের বর্ণিল বিভায় তিনি এই অধ্যায়টিকে করে তুলেছিলেন সুষমামণ্ডিত, আলোকজ্জ্বল। তাঁর জীবন কুরআনময়। কুরআনের তরে নিবেদিত। এটি গতানুগতিক কোনো জীবন ছিল না, ছিল দেশ-জাতির তরে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও কালজয়ী আদর্শ ইসলামকে উপজীব্য করে পৃথিবীর একমাত্র বিশুদ্ধ মহাগ্রন্থ আল কুরআন শিক্ষাদানের একটি অধ্যায়ের বর্ণিল মহড়া। শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও আকাবির আসলাফদের অনুসরণে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই জীবনের মহীরূহতুল্য ব্যক্তি জয় করেছিল কাল ও সময়কে। তিনি কালের চক্রজালে হারিয়ে যাবেন না। তিনি ছিলেন কালোত্তীর্ণ জীবনের অধিকারী। নিঃস্বার্থ কুরআনের খেদমতে নিজেকে নিবেদিত করে জয় করে নিয়েছিলেন মানুষের মনন। যারা জীবন দিয়ে একটি ঐশীগ্রন্থ আল কুরআনের তরে নিজের জীবনকে সুশোভিত করেন, কুরআনে নূর স্মরণযোগ্য করে তোলে ব্যক্তির জীবন। তাঁরা কখনও হারিয়ে যান না বিস্মৃতির অন্তরালে।

রঈসুল মুআল্লিমীন হজরত মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ. আজ নেই, কিন্তু কীর্তির যে বিশাল ব্যাপ্তি রেখে গেছেন তা অক্ষয় হয়ে আছে। এর ক্ষয় নেই লয় নেই। কুরআন শিক্ষার যে মিনার তিনি রচনা করে গেছেন আমাদের চোখের সামনে, এক জীবনে তিনি কয়েকজীবনের কাজ করে গেছেন। যে ধাপগুলো অতিক্রম করতেও সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। কুরআন শিক্ষার যে বিপ্লব ও আদর্শের স্ফুরণ তিনি ঘটিয়েছেন তার সৌরভ ও সুবাসে আমরা যুগপৎ মুগ্ধ ও বিমোহিত। আকাবিরের মিছিলের অন্যতম সদস্য এই মনীষীর জীবন থেকে আমাদের আহরণ করার আছে অনেক কিছু, শেখার আছে তার থেকেও বেশি।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাওফীক দাও, মাওলানা রহমতুল্লাহ রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন থেকে আমরা যেন আমাদের মুক্তি ও কামিয়াবির পাথেয় গ্রহণ করতে পারি। তাঁর দারাজাত বুলন্দির জন্যও আমরা বিনীত প্রার্থনা জানাচ্ছি তোমার সুমহান দরবারে। আল্লাহুম্মা আমিন।

আরো পড়ুন-

মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী রহ. এর আলোকিত জীবন, পর্ব—১

1 thought on “মাওলানা রহমাতুল্লাহ রহ.: জীবন, কর্ম ও অবদান”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top