শরিয়ত কি ও কেন? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

শরিয়ত কি ও কেন? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা

সুষ্ঠু, সুন্দর ও উন্নত জীবন পরিচালনার জন্য আল্লাহ তা‘আলা শেষ নবীর উম্মতকে এক উৎকৃষ্ট জীবন-দর্শন উপহার দিয়েছেন। ইসলামী পরিভাষায় যাকে ‘শরীয়ত’, ‘ইসলামী আইন’ বা মানুষের কল্যাণে আল্লাহপ্রদত্ত এক মহান জীবনব্যবস্থা বলে ।

শরীয়ত যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা তাই মানুষের স্বার্থকে ঘিরেই শরীয়তের বিধানগুলো সাজানো হয়েছে। যার উদ্দেশ্য হলো মানুষের কল্যাণ সাধন ও ক্ষতিরোধ।

 এ বিষয়ে ডা. আব্দুল কারিম আয্ যায়দান রহ. বলেন:

وقد ثبت بالاستقراء وتتبع الأحكام المختلفة في الشريعة أن القصد الأصلي لها هو تحقيق مصالح العباد وحفظ هذه المصالح ودفع الضرر عنهم، إلا أن هذه المصالح ليست هي ما يراه الإنسان مصلحة له ونفعاً حسب هـداء، وإنما المصلحة ما كانت مصلحة في ميزان الشرع لا في ميزان الأهواء والشهوات، فالإنسان قد يرى – مدفوعاً بهواه – النافع ضاراً، والضار نافعاً، متأثراً بشهواته النفسية

অর্থাৎ: শরীয়তের বিভিন্ন বিধান প্রবর্তন, অনুসরণ ও গবেষণার মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, শরীয়তের মূল উদ্দেশ্যই হল মানুষের স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করা, সর্বক্ষণের জন্য স্বার্থগুলো সংরক্ষণ করা এবং মানব জাতির ক্ষতি রোধ করা।1

ইমাম শাতিবি রহ. বলেন :

إِذًا ثَبَتَ أَنَّ الشَّارِعَ قَدْ قصد بالتشريع إقامة المصالح الأخروية والدنيوية، فذلك عَلَى وَجْهٍ لَا يَخْتَلُّ لَهَا بِهِ نِظَامٌ، لَا بِحَسَبِ الْكُلِّ وَلَا بِحَسَبِ الْجُزْءِ، وَسَوَاءٌ فِي ذَلِكَ مَا كَانَ مِنْ قَبِيلِ الضَّرُورِيَّاتِ أَوِ الْحَاجِيَّاتِ أَوِ التَّحْسِينِيَّاتِ، فَإِنَّهَا لَوْ كَانَتْ مَوْضُوعَةً بِحَيْثُ يُمْكِنُ أَنْ يَخْتَلَّ نِظَامُهَا أَوْ تَنْحَلَّ أَحْكَامُهَا، لَمْ يَكُنِ التَّشْرِيعُ مَوْضُوعًا لَهَا، إِذْ لَيْسَ كَوْنُهَا مَصَالِحَ إِذْ ذَاكَ بِأَوْلَى مِنْ كَوْنِهَا مَفَاسِدَ، لَكِنَّ الشَّارِعَ قَاصِدٌ بِهَا أَنْ تَكُونَ مَصَالِحَ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَلَا بُدَّ أَنْ يَكُونَ وَضْعُهَا عَلَى ذَلِكَ الْوَجْهِ أَبَدِيًّا وَكُلِّيًّا وَعَامًّا فِي جَمِيعِ أَنْوَاعِ التَّكْلِيفِ وَالْمُكَلَّفِينَ من جميع٤ الْأَحْوَالِ، وَكَذَلِكَ وَجَدْنَا الْأَمْرَ فِيهَا، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ.

অর্থাৎ: শরিয়ত মানুষের কল্যাণের জন্য প্রণীত, যা দুনিয়া এবং আখিরাতে মঙ্গল বয়ে আনে। শরিয়তের বিধান এমনভাবে প্রণীত যে, এগুলি কোনো অংশে একে অপরের সাথে সংঘর্ষ বা ব্যাঘাত ঘটাবে না, বরং সব ক্ষেত্রেই মানুষের কল্যাণ এবং শান্তি নিশ্চিত করবে।2

বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন : আল-মুয়াফাকাত: ২/৬২

সুতরাং আমরা বলতে পারি ইসলামী শরিয়ত আমাদের কল্যাণেই দেওয়া হয়েছে। তবে মানুষের স্বল্প বুদ্ধি বিবেচনায় যাই কল্যাণকর ও উপকারী বলে মনে হবে শরীয়ত তাই গ্রহণ করবে বিষয়টি এমন নয়। বরং অবশ্যই তা শরীয়তের পাল্লায় উপকারী ও কল্যাণকর বলে বিবেচিত হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এটাও মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ বাহ্যিকভাবে মানুষ যেগুলোকে কল্যাণকর ও উপযোগী মনে করে কখনো কখনো সেগুলো ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে এবং যেগুলোকে অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বলে মনে করে সেগুলো উপকারী ও কল্যাণকর হয়ে থাকে।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَعَسَىٰ أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ ۖ وَعَسَىٰ أَن تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ ۗ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

3বস্তুতঃ তোমরা এমন বিষয়কে অপছন্দ করছ যা তোমাদের পক্ষে বাস্তবিকই মঙ্গলজনক, পক্ষান্তরে তোমরা এমন বিষয়কে পছন্দ করছ যা তোমাদের জন্য বাস্তবিকই অনিষ্টকর এবং আল্লাহই (তোমাদের ভাল-মন্দের ব্যাপারে) অবগত আছেন এবং তোমরা অবগত নও।

সুতরাং দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের সর্বোত্তম স্বার্থ সম্পর্কে তিনিই বেশি অবগত। তাই তার কথায় সাড়া দেওয়া এবং তার আদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত। এজন্যই কেবল মানুষের বুদ্ধি বিবেচনায় উপকারী হলেই সে স্বার্থ শরীয়ত সংরক্ষণ করে না।

এর পরও যদি বলি একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির সবচে বড় পাওয়া কি থাকতে পারে – যদি পৃথিবী থেকে সব ধরনের অন্যায় মুছে যেতো। সবার জীবনের নিরাপত্তা থাকতো। বংশ সুরক্ষিত থাকতো। মাল সম্পদ হেফাজতে থাকতো। ব্রেইন সুস্থ থাকতো। সর্বপুরি দ্বীন হেফাজতে থাকতো। গবেষণায় জানা যায় এগুলোই মানুষের মৌলিক চাহিদা। আর শরীয়ত এ সবগুলোকেই মূল্যায়ন করেছে।

আমরা যদি শরীয়তের উদ্দেশ্যকে আরেকটু বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে দেখবো শরীয়ত মানুষের প্রয়োজনগুলোকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে।

  1. ضروريات (Essential) — “জরুরিয়্যাত” বা অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য
  2. حاجيات (Necessary) —  “হাজিয়্যাত” বা প্রয়োজনীয়।
  3. تحسينيات (Beautifications/Improvements) — “তাহসিনিয়্যাত” বা সৌন্দর্য বর্ধক।

এই প্রত্যেকটির পরিপূরক হিসেবে আরেকটি প্রকার রয়েছে । সেটি হলো সেটি হলো:

 مكملات (Completeness/Perfections) — “মুকাম্মালাত” বা পূর্ণতা

নিম্নে আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রকারের বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্ট করবো, ইনশাআল্লাহ।

প্রথমটি হলো-  ضروريات (Essential) — “জরুরিয়াত” বা অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য

“জরুরিয়্যাত” এর সংজ্ঞা (Definition):

الضروريات هي الأمور الأساسية التي لا غنى عنها لقيام حياة الإنسان واستقرار المجتمع، وتشمل حفظ الدين، والنفس والعقل، والنسل، والمال

 অর্থাৎ, “জরুরিয়্যাত” (ضروريات) হল ইসলামি শরিয়াহর এমন মৌলিক উদ্দেশ্য, যা মানুষের জীবন ও সমাজে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে অত্যাবশ্যক। এর মাধ্যমে ধর্ম, জীবন, বুদ্ধি, বংশধারা এবং সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। এগুলো রক্ষা করা ব্যতীত সমাজে ভারসাম্য ও শান্তি বজায় রাখা সম্ভব নয়।

ইমাম শাতিবি বলেন,

فَأَمَّا الضَّرُورِيَّةُ، فَمَعْنَاهَا أَنَّهَا لَا بُدَّ منها في قيام مصالح الدين والدنيا بِحَيْثُ إِذَا فُقِدَتْ لَمْ تَجْرِ مَصَالِحُ الدُّنْيَا عَلَى اسْتِقَامَةٍ، بَلْ عَلَى فَسَادٍ وَتَهَارُجٍ١ وَفَوْتِ حَيَاةٍ، وَفِي الْأُخْرَى فَوْتُ النَّجَاةِ وَالنَّعِيمِ

 অর্থাৎ: “জরুরিয়্যাত” (অপরিহার্য প্রয়োজন) এর মানে হলো, এমন কিছু মৌলিক প্রয়োজন যা ধর্মীয় ও দুনিয়াবী প্রয়োজন পূরণের জন্য অপরিহার্য। যদি এগুলো না থাকে, তবে পৃথিবীতে মানুষ সুস্থভাবে চলতে পারবে না, বরং তা অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা এবং জীবনের প্রতি বিপদের সৃষ্টি করবে। আর আখিরাতে, এই অভাবের কারণে মুক্তি, নিরাপত্তা এবং চিরন্তন সুখ হারিয়ে যাবে।4

বিস্তারিত জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন

علم المقاصد الشرعية গ্রন্থে বলা হয়েছে:

المقاصد الضرورية كما ذكرنا هي الصالح التي لا بد منها من أجل أن يقوم أمر الحياة ونظام الوجود على صلاح واستقرار وإسعاد في الدين والدنيا.

অর্থাৎ:জরুরিয়্যাতের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন প্রয়োজনীয় বিষয় যা জীবনের সঠিক চলমানতা, অস্তিত্বের ভারসাম্য এবং ধর্ম ও দুনিয়ায় মানুষের শান্তি ও সুখ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।5

বিস্তারিত জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন

التعليق على الموافقات এর মাঝে বলা হয়েছে:

الضروريات: ما لا تقوم الحياة إلا بها

অর্থাৎ:  الضروريات (মৌলিক প্রয়োজন) এগুলো এমন বিষয়, যা ছাড়া জীবন ধারণ সম্ভব নয়। এগুলো জীবনের মূল ভিত্তি এবং অপরিহার্য।6

বিস্তারিত পড়ুন এই লিংকে:

সুতরাং উপরুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে,  “জরুরিয়্যাত” (ضروريات)  বা মৌলিক প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো মূলত মানুষের জীবনে বা সমাজে যেসব বিষয় অত্যন্ত জরুরি, যা ছাড়া মানব জীবনের সুষ্ঠু কার্যক্রম বা শান্তিপূর্ণ অবস্থান সম্ভব নয়, সেগুলোকে নির্দেশ করে। আর সেগুলো হলো পাঁচটি। যা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

“জরুরিয়্যাত” পাঁচটি মৌলিক উপাদান (Five Essentials) :

  1.  (حفظ الدين): দ্বীন বা ধর্মের সুরক্ষা।
  2. (حفظ النفس): মানুষের জীবন বা আত্মার সুরক্ষা।
  3. (حفظ النسل): পরিবার ও বংশের সুরক্ষা।
  4. (حفظ العقل):: মানসিক ও বুদ্ধিগত ক্ষমতার সংরক্ষণ বা জ্ঞান ও মস্তিষ্কের সুরক্ষা।
  5. (حفظ المال): আর্থিক সম্পদ বা মৌলিক চাহিদাগুলোর সংরক্ষণ।

এই পাঁচটি মৌলিক বিষয়কে ইসলামের দৃষ্টিতে(ضروريات) “জরুরিয়্যাত” বলা হয়, যা সমাজের স্বাভাবিক এবং শান্তিপূর্ণ চলাচল নিশ্চিত করতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।  (مقاصد الشريعة) বা শরিয়তের বিভিন্ন উদ্দেশ্যের মাঝে উল্লিখিত পাঁচটিকে প্রথম কাতারে রাখা হয়েছে এবং ইসলামে এসব বিষয় রক্ষার জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।এই পাঁচটি মৌলিক বিষয় ইসলামে কীভাবে সুরক্ষিত, তা আমরা আলাদা করে কিছু দালিলিক প্রমাণের মাধ্যমে বুঝতে পারি:

 ১.  (حفظ الدين) দ্বীন বা ধর্মের সুরক্ষা:

(حفظ الدين) দ্বীন বা ধর্মের সুরক্ষা বলতে কি বুঝায়? :

المقاصد الضرورية لحفظ الدين: ومعناها: تثبيت أركان الدين وأحكامه في الوجود الإنساني والحياة الكونية، وكذلك العمل على إبعاد ما يخالف دين الله ويعارضه، كالبدع ونشر الكفر، والرذيلة، والإلحاد، والتهاون في أداء واجبات التكليف. علم المقاصد الشرعية، نور الدين الخادمي، ص79 

 অর্থাৎ: (حفظ الدين) দ্বীন বা ধর্মের সুরক্ষা এর মানে হলো, দ্বীনের মূল কাঠামো ও বিধানসমূহকে মানবজীবন এবং পৃথিবীতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা, এবং আল্লাহর দ্বীনের বিরোধী সকল বিষয়, যেমন: কুফর, পাপাচার, নাস্তিকতা, দ্বীনি কর্তব্যে অবহেলা, এবং নতুন উদ্ভাবিত কার্যকলাপ বা বিদআতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করা।7

ইলমুল মাকাসিদিশ শারইয়্যাহ,নূরুদ্দিন আল-খাদিমি, পৃষ্ঠা ৭৯

(حفظ الدين): দ্বীন বা ধর্মের সুরক্ষা: গুরুত্ব ও বাস্তব প্রয়োগ

শারিয়ার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর দ্বীনের সুরক্ষা। এটি সেই চিরন্তন ধর্ম, যা আল্লাহ তাআলা মানুষদের জন্য পাঠিয়েছেন, এবং তাঁর অসীম অনুগ্রহে, তিনি ইসলামকে সকল ধর্মের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। ইসলাম একমাত্র সেই ধর্ম, যা আল্লাহ তাআলার কাছে গ্রহণযোগ্য, এবং তিনি অন্য কোনো ধর্মকে গ্রহণ করেন না।

যেমনটি আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন:

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ

“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হল ইসলাম।”8


এছাড়া, আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:


وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الإِسْلاَمِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ


“যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করবে, তা তার কাছ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না, এবং সে পরকালে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”9

এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে সুরক্ষিত রেখেছেন, যাতে পৃথিবীতে এ ধর্মের সত্যতা অটুট থাকে। অন্য সকল ধর্ম, যে কোনো পর্যায়ে, মানুষের প্রবৃত্তি ও মতামতের কারণে বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়েছে। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা চিরকাল নির্ভূল ও অক্ষুণ্ণ থাকবে।

কিন্তু, যখন মানুষ দ্বীনহীন হয়ে পড়ে, তখন তার অবস্থা হয় এক বিপদজনক প্রেক্ষাপটে। তার জীবন হয়ে ওঠে অন্ধকার, যেখানে শক্তিশালী দুর্বলকে শোষণ করে, এবং ظالم নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। এমনকি দ্বীনহীন মানুষ একপ্রকার মৃত, যা কুরআনে আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন:



أَوَ مَن كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ فِي النَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُ فِي الظُّلُمَاتِ لَيْسَ بِخَارِجٍ مِّنْهَا

“একটু বল তো, যে ব্যক্তি ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য এক আলোর ব্যবস্থা করেছি, যার সাহায্যে সে মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে,  সে কি ওই ব্যক্তির মত হতে পারে, যার অবস্থা এই যে, সে অন্ধকার দ্বারা পরিবেষ্টিত, যা থেকে সে কখনও বের হতে পারবে না? এভাবেই কাফেরদের দৃষ্টিতে তাদের কৃতকর্মকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।”10


এছাড়া, কুরআনে আরও বর্ণনা করা হয়েছে দ্বীনের অভাবে মানুষের পশুর মতো আচরণের:

وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ

 “আর যারা কুফর অবলম্বন করেছে, তারা (দুনিয়ায়) মজা লুটছে এবং চতুষ্পদ জন্তু যেভাবে খায়, সেভাবে খাচ্ছে। তাদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম।”11

কিন্তু, তাদের অবস্থা আরও করুণ, কেননা তারা কখনও সঠিক পথে চলতে সক্ষম নয়। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:


أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا

“তুমি কি মনে করো, তাদের অধিকাংশই শোনে অথবা বুঝে? তারা তো পশুর মতো, বরং তারা আরও অধম।”12


(حفظ الدين) দ্বীন বা ধর্ম সুরক্ষার উপাদান:

 দ্বীন বা ধর্মের সংরক্ষণ মূলত তিনটি মূল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে: ইসলাম, ঈমান এবং ইহসান। এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তি কুরআনে প্রোথিত, আর সুন্নাহতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।

ইমাম শাতেবী রহ. বলেন:

দ্বীনের সুরক্ষা মূলত তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: ইসলাম, ঈমান এবং ইহসান। এই তিনটি উপাদান কুরআনে স্থাপিত এবং সুন্নাহতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া, দ্বীনের পূর্ণতা নিশ্চিত করতে আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা রয়েছে:


  1. الدُّعَاءُ إِلَيْهِ بِالتَّرْغِيبِ وَالتَّرْهِيبِ(দ্বীনের প্রতি আহ্বান): আকর্ষণ, উৎসাহ ও সতর্কবাণীর মাধ্যমে মানুষকে দ্বীনের দিকে আহ্বান করা।    
  2. جِهَادُ مَنْ عَانَدَهُ أَوْ رَامَ إِفْسَادَهُ (দ্বীনের বিরোধিতাকারী ও দ্বীন ধংসের অপচেষ্টকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ):  যারা দ্বীনের বিরুদ্ধে কাজ করে বা এর মূলনীতি ধ্বংস করার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে জিহাদ করা।
  3. تَلَافِي النُّقْصَانِ الطَّارِئِ فِي أَصْلِهِ  (প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নীতিগুলোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট ক্ষতির প্রতিকার):13

অর্ধাৎ: ইমাম কর্তৃক ধর্মের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য শরীয়তের হুদুদ (বিচার ও শাস্তি) প্রয়োগের মাধ্যমে ধর্মীয় নীতিগুলির ক্ষেত্রে সৃষ্ট ক্ষতির প্রতিকার করা।

বিস্তারিত পড়ুন : নাজরিয়্যাতুল মাকাসিদ ইনদাল ইমাম আশ্-শাতিবী, আহমাদ রাইসুনী পৃ.156

উপরোক্ত তিনটি পন্থার বিশ্লেষণ:

دين সুরক্ষার প্রথম পন্থা: দাওয়াত



ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের কথা ভাবলেই আমাদের সামনে প্রথমেই আসে দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা। ইসলামের সৌন্দর্য, বিধি-বিধান, এবং আচার-আচরণ মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ ও অপপ্রচার চালানো হয়, তা নিরসন করা দাওয়াতের অন্যতম দিক। এটি এমন একটি কাজ, যা প্রতিটি মুসলিমের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব। আমাদের فرداً فرداً (এককভাবে) এবং جماعةً (দলবদ্ধভাবে) دين প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো নবী-রাসুলদের অন্যতম প্রধান কাজ। তারা এই উদ্দেশ্যে অনেক কষ্ট ও বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। তারা আঘাত সহ্য করেছেন, আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছেন এবং নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। এটি তাদের জন্য যেমন একটি মহান দায়িত্ব ছিল, আমাদের জন্যও তেমনই।


ইসলামবিরোধী প্রচারণা এবং আমাদের গাফিলতি

প্রত্যেক মানুষই নিজের চিন্তা ও মতবাদ প্রচারের জন্য দাওয়াত দেয়, আর ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো এই কাজে অত্যন্ত সচেষ্ট। তারা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে—তাদের আদর্শ ছড়িয়ে দিতে পেন্সিল থেকে শুরু করে ইন্টারনেট পর্যন্ত প্রতিটি মাধ্যম ব্যবহার করছে। নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করছে, প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করছে, এবং এমনকি কৌশলগত পাঠ্যক্রমও তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তারা বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে—”কিভাবে মুসলিমদের খ্রিস্টান বানানো যায়?” এমনকি তারা এই উদ্দেশ্যে বিস্তারিত পাঠ্যক্রম চালাচ্ছে।

অন্যদিকে, আমরা মুসলিমরা কি এমন কোনো সংগঠিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি? কোনো মুসলিমকে কি আমরা আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে দেখেছি? বরং, আমরা প্রায়শই দেখি, মুসলিমরা এই মহান দায়িত্বে অবহেলা করছে। ইসলামের প্রচারে তাদের গাফলতি আজ স্পষ্ট।

এখন প্রশ্ন হলো, যারা সত্য জানে এবং বিশ্বাস করে যে ইসলামই একমাত্র সঠিক ধর্ম, তারা যদি ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী না হয়, তবে কীভাবে আশা করা যাবে যে, তারা ইসলামের শত্রুদের মিথ্যা প্রচারণা এবং বিকৃতির জবাব দেবে? ইসলামবিরোধীরা যখন সর্বশক্তি দিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, তখন আমাদের নীরব থাকা কি ইসলামের প্রতি অবহেলা নয়?


দাওয়াতের অবহেলার পরিণাম

দাওয়াতের প্রতি অবহেলা ইসলামের অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি। এটি دين এর পরিচিতিকে বিলীন করে দেয় এবং কুফরের প্রসারকে উন্মুক্ত করে। কাফিররা তাদের মিথ্যা দিয়ে মানুষের হৃদয়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, আর আমরা নিজেদের সঠিক ধর্মের পরিচয় তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:


“আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম।”14

তিনি আরও বলেন:

“তোমরাই সর্বোত্তম উম্মাত, মানবজাতির (সর্বাত্মক কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভুত করা হয়েছে, তোমরা সৎকাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখো ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো।”15


তিনি আরও বলেন:


“জ্ঞান-বুদ্ধি আর উত্তম উপদেশের মাধ্যমে তুমি (মানুষকে) তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান জানাও আর লোকেদের সাথে বিতর্ক কর এমন পন্থায় যা অতি উত্তম।”16


দাওয়াত: دين সুরক্ষার অন্যতম উপায়

ইসলামের দাওয়াত দেওয়া আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব। এটি دين সুরক্ষার অন্যতম মৌলিক উপায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন: “আমার পক্ষ থেকে এক আয়াত হলেও পৌঁছে দাও।” আমাদের উচিত নিজেদের প্রশ্ন করা: আমরা কি কখনো কাউকে ইসলামের পথে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছি? কাফিরকে ইসলাম গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেছি? কিংবা কোনো মুসলিমকে তাওবা করে ইসলামের আদর্শে ফিরে আসার দাওয়াত দিয়েছি?

ইসলামের দাওয়াত মানুষকে دين এর প্রকৃত শিক্ষা দেয়, বিভ্রান্তি দূর করে এবং ইসলামের সত্যতা সকলের সামনে তুলে ধরে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:


“আমি তোমাকে সমগ্র মানবমন্ডলীর জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। “17


দাওয়াত হল دين সুরক্ষার প্রথম এবং সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এটি এমন এক কার্যক্রম, যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং دين এর প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য করা হয়। এটি ধর্মের শত্রুদের মিথ্যা অপপ্রচার এবং বিকৃতির জবাব দেয়। তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত আল্লাহর পথে আহ্বান জানানো এবং এই মহান কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন:


“(হে নবী!) বলে দাও, এই আমার পথ, আমি পরিপূর্ণ উপলব্ধির সাথে আল্লাহর দিকে ডাকি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারাও। আল্লাহ (সব রকম) শিরক থেকে পবিত্র। যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।”18


আল্লাহ আমাদের সবাইকে دين সুরক্ষার দায়িত্ব পালনে তাওফিক দান করুন। আমিন।

دين সুরক্ষার দ্বিতীয় পন্থা: জিহাদ

জিহাদ: ইসলামের সুরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়


ইসলামিক শরীয়াহ دين (ধর্ম) সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উপায় নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জিহাদ। এটি তখন প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, যখন দাওয়াত অস্বীকৃতি, কট্টর বিরোধিতা বা অবজ্ঞার সম্মুখীন হয়। দাওয়াত যারা গ্রহণ করে, তাদের জন্য এটি কল্যাণকর। কিন্তু যারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং دين-এর প্রসারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাদের ক্ষেত্রে জিহাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

যখন دين-এর বিস্তার শক্ত বাধা বা অজানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, তখন সেই বাধাগুলোকে ভাঙার জন্য লোহা দিয়ে লোহায় আঘাত করা এবং শক্তির সঙ্গে শক্তি প্রতিরোধ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। এর মাধ্যমে, অবাধ্যদের শাসন করা হয় এবং دين-এর প্রসার নিশ্চিত হয়।


জিহাদের উদ্দেশ্য:


জিহাদের মূলত দুটি উদ্দেশ্য রয়েছে:
১.دين-এর প্রসার এবং তার পথের বাধাগুলো শক্তি দিয়ে অপসারণ করা।
২. ইসলাম ও মুসলিমজাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা, যাতে শত্রুরা মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করতে না পারে।


আল্লাহ তা‘আলা বলেন:


 “হে মু’মিনগণ! যে সব কাফির তোমাদের নিকটবর্তী তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যাতে তারা তোমাদের মধ্যে দৃঢ়তা দেখতে পায়, আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।”19


তিনি আরও বলেন:


 “মুশরিকদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে। জেনে রেখ, আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। “20

আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদেরকে জিহাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:


 “তোমরা কাফিরদের মুকাবিলা করার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও সদাসজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে যদ্দবারা আল্লাহর শক্র ও তোমাদের শক্রদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করবে, এছাড়া অন্যান্যদেরকেও যাদেরকে তোমরা জাননা, কিন্তু আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু ব্যয় কর, তার প্রতিদান তোমাদেরকে পুরোপুরি প্রদান করা হবে, তোমাদের প্রতি (কম দিয়ে) জুলুম করা হবেনা। “21


এই প্রস্তুতির মধ্যে রয়েছে শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি। যদি আমরা প্রস্তুত না হই, তবে আমাদের ঈমান দুর্বল হয়ে যাবে এবং আমরা দায়িত্ব পালনে অক্ষম হব।


 সুতরাং যদি মুসলিমরা শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি অর্জন করে থাকে তাহলে দ্বীন সুরক্ষায় আক্রমণাত্মক জিহাদ করতে হবে। আর যদি শক্তি না থাকে, তবে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ করতে হবে এবং আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।


আল্লাহর পথে জিহাদের মহত্ব ও উপকারিতা


জিহাদ ইসলামে একটি মহান ও পুণ্য কাজ হিসেবে বিবেচিত। এটি শুধুমাত্র শারীরিক সংগ্রাম নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতিটি মুসলিমের আত্মিক ও নৈতিক সংগ্রামও। জিহাদ সৎ ও ন্যায়পরায়ণ কাজের প্রতি উৎসাহিত করে এবং মুমিনের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। ইসলামের ইতিহাসে জিহাদের ফজিলত অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম।

প্রথমত: একতা ও ঐক্যের প্রতিষ্ঠা

ইতিহাসের অনন্য অধ্যায়গুলিতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, জিহাদ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক শক্তিশালী মাধ্যম। রাসূল (সা.) নিজেও তা নিশ্চিত করেছেন।

সহীহ মুসলিমে আরফাজা বিন শরিহ (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) বলেছেন,

“অচিরেই নানা প্রকার ফিৎনা-ফাসাদের উদ্ভব হবে। যে ব্যক্তি ঐক্যবদ্ধ উম্মাতের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রয়াস চালাবে, তোমরা তরবারি দিয়ে তার গর্দান উড়িয়ে দেবে, সে যে কেউ হোক না কেন।”22

এই নির্দেশ মুসলমানদের একত্রিত হওয়া এবং যেকোনো ধরনের বিভাজন থেকে মুক্ত থাকার আহ্বান জানায়।

নাসায়ী’র বর্ণনায় বলা হয়েছে, সাল্লাল্লাহু  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

আমার পরে অনেক ফিতনা দেখা দেবে, এসময় তোমরা যাকে দেখবে মুসলমানদের দল হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, অথবা উম্মতে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছে; সে যে-ই হোক না কেন, তাকে হত্যা করবে। কেননা আল্লাহ্ তা’আলার রহমতের হাত মুসলমানদের দলের উপর থাকবে। আর যে ব্যক্তি জামা’আত থেকে পৃথক হয়ে যায়, শয়তান তার সাথী হয় এবং তাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেয়।23

 এর মাধ্যমে মুসলমানদের ঐক্য রক্ষায় জিহাদের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যা শয়তানের ষড়যন্ত্র ও বিভেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

দ্বিতীয়ত: জিহাদ প্রকৃত আল্লাহপ্রেমীদের চিহ্নিতকরণের পথ


যারা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার দাবি করেন, তাদের মধ্যে অনেকেই যখন আল্লাহর পথ রক্ষার জন্য, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান আসে তখন তারা  সাড়া দেয় না । এতে তাদের ভালোবাসা প্রকৃত রূপ ফুটে উঠে। যেমনটা ঘঠেছিলো মোনাফেকদের ক্ষেত্রে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:


«হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি তার দীন থেকে ফিরে যাবে তাহলে অচিরেই আল্লাহ এমন কওমকে আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারা তাঁকে ভালবাসবে। তারা মুমিনদের উপর বিনম্র এবং কাফিরদের উপর কঠোর হবে। আল্লাহর রাস্তায় তারা জিহাদ করবে এবং কোন কটাক্ষকারীর কটাক্ষকে ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তা দান করেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। » 24

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, محبة  (ভালোবাসা) প্রকৃতপক্ষে জিহাদের সাথে গভীর সম্পর্কিত। যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে, সে তাদের পছন্দ-অপছন্দ অনুসরণ করবে। তার ভালোবাসা শুধু কথায় নয়, বরং তার কাজের মধ্যে ফুটে ওঠে। যেভাবে একজন প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা তাকে সেই ব্যক্তির পছন্দের জিনিসগুলো ভালোবাসতে এবং অপছন্দের জিনিসগুলো ঘৃণা করতে প্ররোচিত করে, তেমনি আল্লাহর ভালোবাসা আমাদেরকে তাঁর আদেশ মেনে চলতে, তাঁর পথে লড়াই করতে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করে।

যখন কোনো মুসলিম আল্লাহর পথে জিহাদ করতে অস্বীকার করে, তখন এটি তার অন্তরে আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি ভালোবাসার দুর্বলতা ও ঈমানের অভাবের লক্ষণ। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে সংগ্রাম থেকে বিরত থাকে, তার হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নেই, আর তা তার আধ্যাত্মিক দুর্বলতারই ইঙ্গিত দেয়।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কুরআনে বলেছেন:

“যদি তোমাদেরকে আঘাত স্পর্শ করে, অনুরূপ আঘাত তো অপর পক্ষকেও স্পর্শ করেছিল। (জয়-পরাজয়ের) এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে আবর্তিত করে থাকি যাতে আল্লাহ মু’মিনদেরকে চিনে নিতে পারেন এবং তোমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন, বস্তুতঃ আল্লাহ যালিমদেরকে ভালবাসেন না। এবং (এ জন্যেও) যেন আল্লাহ মু’মিনদেরকে সংশোধন করেন ও কাফিরদের নিশ্চিহ্ন করেন।”25

এ আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, জিহাদ শুধুমাত্র বাহ্যিক সংগ্রাম নয়, বরং এটি মুমিনদের অন্তরের পরীক্ষাও। এটি তাদের ঈমানের প্রকৃত শক্তি পরিমাপ করে এবং তাদের বিশ্বাসের সত্যিকারের অবস্থা উন্মোচন করে। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের এই পরীক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের বিশ্বাসের পরিশুদ্ধি ঘটান, তাদেরকে শক্তিশালী করেন এবং কাফিরদের পরাজিত করেন।

অতএব, যেকোনো জিহাদী সংগ্রাম একদিকে যেমন আল্লাহর পথে লড়াইয়ের প্রমাণ, তেমনি এটি মুমিনদের অন্তরের বিশুদ্ধতা ও আল্লাহর প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসার প্রকাশ।

তৃতীয়ত:  জিহাদ সম্মান ও মর্যাদার উৎস

জিহাদ একটি অমূল্য সম্মান অর্জনের পথ। তাবরানি’তে আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন,

“যে জাতি জিহাদ পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাদের উপর শাস্তি দিবেন।”26

আল-মুজাম আল-আওসাত, তাবরানী  – খণ্ড. ৪ পৃ. 184 হাদিস নং 3839

অন্য এক হাদিসে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- বলেন:

যখন তোমরা ঈনা পদ্ধতিতে ব্যবসা করবে, গরুর লেজ আঁকড়ে ধরবে, কৃষিকাজেই সন্তুষ্ট থাকবে এবং জিহাদ ছেড়ে দিবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা ও অপমান চাপিয়ে দিবেন। তোমরা তোমাদের দ্বীনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তোমাদেরকে এই অপমান থেকে মুক্তি দিবেন না।27

সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুল ইজারা (ভাড়া ও শ্রম বিক্রয়) হাদিস নং: 3462

সুতরাং জিহাদ সমাজে সম্মান এবং মর্যাদা লাভের পথ, আর যারা এটি পরিত্যাগ করে তারা লাঞ্ছনা এবং দুর্বলতার শিকার হয়। অতএব, জিহাদ সম্মান এবং ঐতিহ্যের একটি নিদর্শন।

চতুর্থত: জিহাদ দমন-পীড়িতদের জন্য মুক্তির পথ উন্মুক্ত করে দেয়

ইসলামে জিহাদ কখনোই মানুষের ওপর ইসলাম গ্রহণে জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্টভাবে কুরআনে বলেছেন:


“দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় হিদায়াত স্পষ্ট হয়েছে ভ্রষ্টতা থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” 28


 তিনি আরও বলেন:


“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে ভূ-পৃষ্ঠে বসবাসকারী সকলেই ঈমান আনত।  তবে কি তুমি মানুষের উপর চাপ প্রয়োগ করবে, যাতে তারা সকলে মুমিন হয়ে যায়?” 29

অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা জবরদস্তিমূলক সকলকে মুমিন বানাতে পারতেন। কিন্তু দুনিয়া যেহেতু পরীক্ষার স্থান এবং সে হিসেবে প্রত্যেকের ব্যাপারে কাম্য সে স্বেচ্ছায়, স্বাধীনভাবে ঈমান আনয়ন করুক, তাই কাউকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুসলিম বানানো আল্লাহ তাআলার নীতি নয় এবং অন্য কারও জন্যও এটা জায়েয নয়।30

ইসলাম কখনোই মানুষের ওপর ধর্ম চাপিয়ে দিতে চায় না।ইসলামের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, জিহাদ একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় যাতে মানুষের ওপর থেকে দমন-পীড়ন এবং বাধা অপসারণ করা যায়। এটি মানুষের জন্য তাদের বিশ্বাস নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, যাতে তারা নির্ভয়ে ধর্ম গ্রহণ বা অস্বীকার করতে পারে।

 আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

“আর বলে দাও, ‘সত্য এসেছে তোমাদের রব্বের নিকট হতে, কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক।’ আমি (অস্বীকারকারী) যালিমদের জন্য আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি যার লেলিহান শিখা তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে গলিত শিশার ন্যায় পানি দেয়া হবে যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে, কতই না নিকৃষ্ট পানীয়! আর কতই না নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থল! ” 31


এখানে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, ধর্ম গ্রহণ বা অস্বীকার করার স্বাধীনতা  মানুষকে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি।

যেহেতু কিছু অত্যাচারী শাসক মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এবং তাদের ওপর জোর করে নিজেদের আদেশ চাপিয়ে দেয়, ইসলামে এমন শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার বিধান রয়েছে। এই জিহাদের মূল লক্ষ্য হলো, মানুষের উপর থেকে দমন-পীড়ন অপসারণ করা এবং তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম গ্রহণ বা অস্বীকার করার স্বাধীনতা প্রদান করা।

অতএব, ইসলামের জিহাদ শুধু আত্মরক্ষার জন্য নয়, বরং এটি এক ধরনের মুক্তির পথ, যার মাধ্যমে দমন-পীড়িত জনগণকে মুক্ত করা হয় এবং তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। ইসলাম মানুষের বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের ধর্ম নির্বাচনের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।

 পঞ্চম: জিহাদ মুসলিম সমাজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে

আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সা.)-কে আল্লাহর পথে জিহাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন, এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, এই জিহাদ মুসলিম সমাজকে কাফিরদের শত্রুতার হাত থেকে রক্ষা করে। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“অতএব তুমি আল্লাহর রাস্তায় লড়াই কর। তুমি শুধু তোমার নিজের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং মুমিনদেরকে উদ্বুদ্ধ কর। আশা করা যায় আল্লাহ অচিরেই কাফিরদের শক্তি প্রতিহত করবেন। আর আল্লাহ শক্তিতে প্রবলতর এবং শাস্তিদানে কঠোরতর।” 32

যদি শত্রুরা লক্ষ্য করে যে, মুসলমানদের মধ্যে দুর্বলতা এবং ভয় বিরাজ করছে, তবে তারা তাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও অবমাননা চালাবে, তাদের সম্মান ও সম্পদ লুট করবে। কিন্তু যখন মুসলমানরা দৃঢ় ঈমান এবং শক্তিশালী জিহাদের মনোভাব নিয়ে সামনে আসে, তখন শত্রুরা তাদের থেকে ভয় পেতে বাধ্য হবে।

রাসূল (সা.) এক হাদিসে বলেছেন, মুসলমানদের মাঝে অপমান ও অন্য জাতির আক্রমণের মূল কারণ হল দুর্বলতা ও ভয়। 33

 ‍সুনান আবি দাউদে সাউবান (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন:

খাদ্য গ্রহণকারীরা যেভাবে খাবারের পাত্রের চতুর্দিকে একত্র হয়, অচিরেই বিজাতিরা তোমাদের বিরুদ্ধে সেভাবেই একত্রিত হবে।এক সাহাবী জিজ্ঞেস করেন, “হে রাসূল!  সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণ কি এরূপ হবে? তিনি বললেনঃ তোমরা বরং সেদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে; কিন্তু তোমরা হবে প্লাবনের স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো। আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের পক্ষ থেকে আতঙ্ক দূর করে দিবেন, তিনি তোমাদের অন্তরে ভীরুতা ভরে দিবেন।
আরেক সাহাবী প্রশ্ন করেন, “হে রাসূল! এই দুর্বলতা কী?”
রাসূল (সা.) উত্তরে বলেন:
“এটি হলো দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা।”34

এই আয়াত ও হাদিসগুলো স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, মুসলমানদের শক্তি ও সম্মান পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়োজন ঈমানের দৃঢ়তা এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামের অটুট প্রতিজ্ঞা। যখন মুসলমানরা সত্যিকারভাবে আল্লাহর পথে তাঁদের কর্তব্য পালন করবে, তখন তারা শত্রুর কাছে পরাভূত নয়, বরং আল্লাহর সাহায্য লাভে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আল্লাহ তাঁদের জিহাদ এবং দৃঢ়তার ফলে শত্রুদের শক্তি ভেঙে দেবেন, এবং তাঁরা নিজেদের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন।

ষষ্ঠত: জিহাদহেদায়াতের পথ

আল্লাহর পথে যারা জিহাদে অংশ নেন, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে সঠিক পথের অনুসারী। আল্লাহ তাদের অন্তরকে আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণতা দেন এবং তাদের জন্য সঠিক পথ উন্মুক্ত করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

“আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায় তাদেরকে আমি অবশ্য অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন।”35

এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করেন, তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর অমুল্য পথ উন্মুক্ত করেন এবং তাদের অন্তরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ তাঁদেরকে সব ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করে সঠিক পথে স্থির রাখেন।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:


“জিহাদ আল্লাহর পথে চলার এক মহামূল্যবান উপায়, যা মুমিনদেরকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করে। আল্লাহ যাদেরকে এই পথে আহ্বান করেন, তাদের জন্য তিনি সমস্ত সৎপথ উন্মুক্ত করে দেন।”36

এছাড়া, খ্যাতনামা আলেম ও ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রহ.) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) বলেছেন:


“যখন মানুষ কোনো বিষয়ে বিভ্রান্ত হয়, তখন সীমান্তের যোদ্ধাদের দিকে তাকাও—কারণ তাদের সাথে থাকে সত্য।”37

বিস্তারিত পড়ুন: (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া খ.28 পৃ. 441)

এটি ইঙ্গিত করে যে, যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেন, তারা নিজেরা সঠিক পথে চলতে অবিচল থাকেন, এবং তাদের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বিধা বা বিভ্রান্তি থাকে না। তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন এক শক্তি এবং দৃঢ়তা দান করা হয়, যা তাদের পথচলা সহজ করে দেয়।

আরও এক মহিমান্বিত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

“যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তিনি তাদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করবেন না।অচিরেই তিনি তাদেরকে হিদায়াত দিবেন এবং তাদের অবস্থা সংশোধন করে দিবেন “38

এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে, যারা তাঁর পথে শহীদ হয়েছেন, তাদের কোনো ত্যাগ বা কাজ ব্যর্থ হবে না। বরং, আল্লাহ তাদের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত প্রেরণ করবেন এবং তাদের অবস্থা আরও সুসংহত করবেন। এখানে হেদায়াত করা বা পথপ্রদর্শনের অর্থ স্পষ্টত জান্নাতের দিকে পথপ্রদর্শন করা। 39

অতএব যারা আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন, তাদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং জান্নাতের পথে একান্ত পথপ্রদর্শন নিশ্চিত।

সুতরাং, জিহাদ কেবল শারীরিক সংগ্রাম বা যুদ্ধ নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে একজন মুমিন তাঁর অন্তরকে শুদ্ধ করে, ঈমানকে দৃঢ় করে এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হয়। আল্লাহ যাদেরকে এই পথে আহ্বান করেন, তারা দুনিয়া এবং আখিরাতে সৎপথের সঠিক পথিক হয়ে ওঠেন, যা তাদের অন্তরে আল্লাহর অনুগ্রহ এবং রহমত প্রতিষ্ঠিত করে।

সপ্তম: জিহাদআত্মশুদ্ধি ও পরিশুদ্ধির এক অনন্য উপায়

জিহাদ এক মহান আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া, যা মুমিনদেরকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করে। এটি তাদের ধৈর্য ধারণ, আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখার শিক্ষা দেয় এবং আখিরাতের প্রতি মনোনিবেশ করতে অনুপ্রাণিত করে। একজন মুমিন, যখন জিহাদে অংশগ্রহণ করে, তখন তার আত্মা পরিশুদ্ধ হয় এবং সে জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখের তুলনায় আখিরাতের স্থায়ী সুখের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।” 40

 جهاد ও مجاهدة এর আসল অর্থ দ্বীনের পথে বাধা বিপত্তি দূর করার জন্যে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা। এখানে এ নিশ্চয়তা দান করা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর পথে আন্তরিকতা সহকারে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করবে তাদেরকে মহান আল্লাহ তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন না। বরং তিনি তাদেরকে পথ দেখান এবং তাঁর দিকে যাওয়ার পথ তাদের জন্য খুলে দেন। তারা তাঁর সন্তুষ্টি কিভাবে লাভ করতে পারে তা তিনি প্রতি পদে পদে তাদেরকে জানিয়ে দেন। এই আয়াতের তফসীরে ফুদাইল ইবন আয়াদ বলেন, যারা বিদ্যার্জনে ব্ৰতী হয়, আমি তাদের জন্য আমলও সহজ করে দেই। 41

অষ্টম: জিহাদ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথ খুলে দেয়

জিহাদ শুধু যুদ্ধ নয়, এটি একটি বৈধ অর্থ উপার্জনের পথও।

রাসূল (সা.) বলেছেন: “আমাকে পাঁচটি বিশেষ উপহার দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবীকে দেওয়া হয়নি, এর মধ্যে একটি হলো গনিমত আমার জন্য বৈধ করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোনো নবী বা সম্প্রদায়ের জন্য ছিল না।”42

 এর মাধ্যমে মুসলমানরা শত্রুদের অর্থনৈতিক আধিপত্য থেকে মুক্তি পায় এবং বৈধ উপার্জন লাভ করতে সক্ষম হয়।

নবম: সওয়াব ও পুরস্কারের নিশ্চয়তা

জিহাদে অংশগ্রহণকারী মুমিনদের জন্য আল্লাহ তায়ালা সওয়াব ও পুরস্কারের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ” আল্লাহর পথের মুজাহিদ (অবশ্য আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞাত কে তাঁর পথে জিহাদ করছে) সর্বদা সিয়াম পালনকারী ও সালাত আদায়কারীর মত। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পথে জিহাদকারীর জন্য এই দায়িত্ব নিয়েছেন, যদি তাকে মৃত্যু দেন তবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন অথবা পুরস্কার বা গানীমতসহ নিরাপদে ফিরিয়ে আনবেন।43

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

“যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাস রেখে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য ঘোড়া প্রস্তুত রাখে, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির পাল্লায় ঘোড়ার খাদ্য, পানীয়, গোবর ও পেশাব ওজন করা হবে।” 44

দশম: সুস্পষ্ট فتح বা বিজয়

জিহাদ মুসলিম উম্মাহর বিজয় এবং মর্যাদার পথ প্রতিষ্ঠা করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

“এবং আরো একটি (অর্জন) যা তোমরা খুব পছন্দ কর। (অর্থাৎ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। আর মুমিনদেরকে তুমি সুসংবাদ দাও” 45

অর্থাৎ জিহাদের মাধ্যমে আখেরাতের নেয়ামত ও বাসগৃহ তো পাওয়া যাবেই; দুনিয়াতেও একটি নগদ নেয়ামত পাওয়া যাবে, তা হচ্ছে আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। এর অর্থ শত্রুদের উপর বিজয় লাভ। 

সুতরাং জিহাদ শুধু শারীরিক সংগ্রাম নয়, এটি আত্মিক, আধ্যাত্মিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির এক সুসংহত মাধ্যম। আল্লাহর পথে যুদ্ধ করা, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সম্মান এবং বিজয়ের পথ সুগম করে তোলে।

জিহাদ সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা এবং এর সঠিক ব্যাখ্যা

বিশ্বজুড়ে “জিহাদ” শব্দটি বিভিন্ন সময়ে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং অনেকেই এটিকে সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে জিহাদ একটি পবিত্র সংগ্রাম, যা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ধর্মীয় অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হয়। ইসলাম কখনও নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতার অনুমোদন দেয় না। এ ব্যাপারে একটি সহজ তুলনা করা যেতে পারে দেশের সেনাবাহিনীর সাথে। যেমন সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় যুদ্ধ করে, ঠিক তেমনি মুজাহিদরা ইসলামের সঠিকতা ও মুসলিমদের অধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করেন। তাদের যুদ্ধ কখনো অকারণে সহিংসতা বা সন্ত্রাসবাদের মধ্যে পরিণত হয় না।

সেনাবাহিনী যেমন নিজেদের জীবনকে বিপদে ফেলতে গিয়ে দেশের সীমান্ত রক্ষা করে, তেমনি মুজাহিদরা তাদের জীবন উৎসর্গ করে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তবে, এই সংগ্রাম শুধুমাত্র ন্যায়বিচার, শান্তি এবং মানবতার কল্যাণে সীমাবদ্ধ থাকে। ইসলামের প্রকৃত জিহাদ কখনো অন্যায় বা অমানবিক কাজের সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং তা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, আল্লাহর নির্দেশ পালন এবং মানবতার সেবা করার এক মহৎ উদ্দেশ্য।

সুতরাং, সেনাবাহিনী যেমন দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যুদ্ধ করে, তেমন মুজাহিদরা ইসলামের সুরক্ষা ও মুসলিম সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করতে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেন। এই দুই ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য এক—সুরক্ষা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা, এবং কখনোই সন্ত্রাসবাদ নয়। নিম্নে আমরা জিহাদের ব্যাপারে মানুষের কিছু ভুল ধারণা উল্লেখ করে সেগুরোর অসারতা উল্লেখ করছি:

ভুল ধারণা ১: জিহাদ শুধুমাত্র যুদ্ধ

অনেকেই মনে করেন যে, “জিহাদ” শব্দটি শুধুমাত্র যুদ্ধ বা আক্রমণকে বোঝায়। এটি একটি গুরুতর ভুল ধারণা। ইসলামে “জিহাদ” মানে একমাত্র যুদ্ধ নয়; বরং এটি নানা ধরনের সংগ্রাম বা প্রচেষ্টা বোঝায়। জিহাদ হল আল্লাহর পথে সংগ্রাম, যা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতে পারে—যেমন আত্মশুদ্ধি, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, ইসলামের প্রচার ইত্যাদি।

প্রমাণ: আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:

وَجَاهِدُوا فِي اللَّـهِ حَقَّ جِهَادِهِ )

“আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ ।”46

আব্দুল্লাহ ইবন মুবারক বলেনঃ এ স্থলে জিহাদ বলে নিজের প্রবৃত্তি ও অন্যায় কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে জিহাদ করা বোঝানো হয়েছে। [বাগভী]

 সুতরাং “জিহাদ” শব্দটি জীবনের নানা ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে এসেছে, যা শুধু যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।


ভুল ধারণা ২: জিহাদ শুধুমাত্র মুসলিমদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

অনেকে মনে করেন, জিহাদ শুধু শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বোঝায়। তবে এটি একটি সীমিত এবং ভুল ধারণা। আসলে, জিহাদ একটি বিস্তৃত পরিভাষা যা আধ্যাত্মিক, নৈতিক, সামাজিক, এবং ব্যক্তিগত সংগ্রামকেও অন্তর্ভুক্ত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ হল নিজের আত্মার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সমাজের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা।
এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‏  الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ ‏

   “যে লোক নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে সে-ই আসল মুজাহিদ।”47

এটি পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, নিজের সৎকর্মে নিয়োজিত থাকা এবং আত্মিক উন্নতি অর্জন করাও একটি বড় জিহাদ।

ভুল ধারণা ৩: জিহাদ মানে নিরীহ মানুষদের হত্যা

কিছু মানুষ ভুলভাবে মনে করেন যে, জিহাদ মানে নিরীহ মানুষের হত্যা করা। তবে এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইসলামে নিরীহ মানুষদের হত্যা নিষিদ্ধ। জিহাদ কখনও নিরীহ মানুষদের হত্যার অনুমোদন দেয় না; বরং জিহাদ ইসলামের খ্যাতি রক্ষার জন্য এবং ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই বৈধ করা হয়েছে।
 আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:

 وَ لَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰهُ اِلَّا بِالۡحَقِّ ؕ وَ مَنۡ قُتِلَ مَظۡلُوۡمًا فَقَدۡ جَعَلۡنَا لِوَلِیِّهٖ سُلۡطٰنًا فَلَا یُسۡرِفۡ فِّی الۡقَتۡلِ ؕ

“আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করনা; কেহ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে আমি প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দিয়েছি। কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; সেতো সাহায্য প্রাপ্ত হয়েছেই।”  48

এটি স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে যে, নিরীহ ব্যক্তিদের হত্যা ইসলামি বিধান ও জিহাদ পরিপন্থী।


ভুল ধারণা ৪: জিহাদ মানে অবৈধ সন্ত্রাসবাদ

অনেক সময় জিহাদকে অবৈধ সন্ত্রাসবাদ হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, কিন্তু ইসলামি জিহাদ কখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমর্থক নয়। ইসলামের যে কোনও সংগ্রাম অবশ্যই ন্যায়বিচার এবং আইনের মধ্যে থাকতে হবে এবং তা মানবতার কল্যাণে হতে হবে। ইসলামে জিহাদ কখনও নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সন্ত্রাসবাদের অনুমোদন দেয় না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হিওয়া সাল্লাম যখন কোন দিকে সৈন্যদল প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বলতেন: তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহরই পথে জিহাদ করে যাও। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, কুফরী করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই তোমরা এই জিহাদ করছো। খেয়ানত করো না, ওয়াদা ভঙ্গ করো না, কারো নাক-কান কেটে বিকৃত করো না, শিশু ও নারীদেরকে হত্যা করো না। অন্য সেনাদল ও বাহিনীকেও এই কথাগুলো শুনিয়ে দিও। আল্লাহ তোমাদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন, তোমাদিগকে নিরাপদে রাখুন। 49

 হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সিরিয়ায়  সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করার সময় নিম্নের উপদেশগুলো দেন:

( হাদীসের অংশ) সেখানে কিছু এমন ধরনের লোক তুমি দেখবে যারা নিজেদেরকে আল্লাহর ধ্যানে নিবেদিত বলে মনে করে (অর্থাৎ খৃষ্টান পদ্রী)। তাদেরকে তাদের অবস্থায় ছাড়ে দিও। কিছু এমন লোক দেখতে পাবে যারা মধ্যভাগে মাথা মুন্ডন করে (তৎকালে অগ্নি উপাসকদের এই রীতি ছিল।) তাদেরকে সেখানেই তলোয়ার দিয়া উড়াইয়া দিবে। দশটি বিষয়ে তোমাকে আমি বিশেষ উপদেশ দিতেছি। উহার প্রতি লক্ষ্য রাখিও । নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকে হত্যা করবে না। ফলন্ত বৃক্ষ কাটবে না, আবাদ ভূমিকে ধ্বংস করবে না, খাওয়ার উদ্দেশ্যে ভিন্ন বকরী বা উট হত্যা করবে না, মৌমাছির মৌচাক পোড়িয়ে দিও না অথবা পানিতে ডুবিয়ে দিও না, গনীমত বা যুদ্ধলব্ধ মাল হতে কিছু চুরি করবে না, হতোদ্যম বা ভীরু হবে না । 50

সুতরাং, জিহাদ কখনও নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সন্ত্রাসবাদের অনুমোদন দেয় না।

সংক্ষেপে; জিহাদ কেন প্রয়োজন?

دين (ধর্ম) সুরক্ষার অন্যতম একটি উপায় হলো জিহাদ। জিহাদ দ্বারা কাফিরদের মুসলিমদের ওপর আধিপত্য প্রতিরোধ করা হয়। জিহাদ ধর্মীয় স্থানগুলো রক্ষা করে এবং মানুষকে শয়তানের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ইবাদতে ফিরিয়ে আনে। এর মাধ্যমে, মানুষ উভয় জগতেই সফলতা লাভ করে।

হে আল্লাহ! আমাদেরকে তোমার دين-এর সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম করো। আমাদের ঈমান বৃদ্ধি করো এবং জিহাদের মাধ্যমে دين-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার তাওফিক দাও। আমিন।

دين সুরক্ষার তৃতীয় পন্থা: تَلَافِي النُّقْصَانِ الطَّارِئِ فِي أَصْلِهِ  (প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নীতিগুলোর মাঝে সৃষ্ট ক্ষতির প্রতিকার) :

“প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় নীতিগুলোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট ক্ষতির প্রতিকার” বলতে বোঝানো হয়, ধর্মীয় নীতিগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করে মানুষের ভ্রান্তি বা ভুল ধারণা দূর করা। এর মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে মানুষকে সঠিক পথের দিকে পরিচালিত করা সম্ভব হয়, যাতে তারা ধর্মীয় নীতিগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে এবং জীবনে তা বাস্তবায়ন করে করতে পারে।

ইসলামের নীতিগুলো মানব জীবনে শান্তি, নৈতিকতা এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। তবে কিছু মানুষের ভুল বোঝাবুঝি, অসতর্কতা কিংবা অপব্যাখ্যার কারণে এসব নীতির যথাযথ প্রয়োগ ব্যাহত হয়। তাছাড়া কিছু মানুষ জেনেবোঝে ইসলামী বিদ্ধানের বিরোধিতা করে। যেমন নির্দেশিত পথে না চলা এবং নিষিদ্ধ পথে হাটে। যেমন ফরজ  ইবাদত ছেড়ে দেয়, জিনা বেভিচারে লিপ্ত থাকে ইত্যাদি। এর ফলে ধর্মীয় নীতিগুলোর মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং সমাজে ইসলামের প্রভাব হ্রাস পায়। আর এই বিভ্রান্তিগুলো প্রতিহত করার কথাই বলা হচ্ছে এখানে। এই ক্ষতির প্রতিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে শুধু ভুল ধারণার সংশোধন হয় না, বরং ন্যায়বিচার, সংহতি ও শান্তির পরিবেশও প্রতিষ্ঠিত হয়।


ধর্মীয় নীতির ক্ষেত্রে সৃষ্ট ভ্রান্তি দূর করার পন্থা অনেক হতে পারে। নিম্নে কয়েকটি তুলে ধরা হলো:


১. সঠিক শিক্ষার প্রসার


ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানী ব্যক্তিদের মাধ্যমে সঠিক শিক্ষার প্রচার করা।
মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা।

২. ভুল ব্যাখ্যার বিরোধিতা করা
ধর্মীয় নীতিগুলোর ভুল ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে অবস্থান নেওয়া।
মানুষকে বোঝানো যে ভুল ব্যাখ্যা কিভাবে সমাজে বিভ্রান্তি ও ক্ষতি সৃষ্টি করে।


৩. আলোচনা ও সংলাপের আয়োজন
বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে বিদগ্ধ আলেমদের সাথে আলোচনার আসর আয়োজন করা।
প্রশ্নোত্তর সভা ও কর্মশালার মাধ্যমে মানুষের ভুল ধারণা দূর করা।


৪. ধর্মীয় গ্রন্থ এবং উৎসগুলোতে সরাসরি রেফারেন্স

মূল ধর্মীয় উৎস যেমন কুরআন, হাদিস ও ইজমা-কিয়াসের সাহায্যে সঠিক জ্ঞান প্রদান করা।
ধর্মীয় গ্রন্থগুলো মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলা এবং তাদের অধ্যয়ন উৎসাহিত করা।

৫. মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার

ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার।
ভিডিও, অডিও এবং লেখনীর মাধ্যমে ভুল ধারণাগুলোর ব্যাখ্যা ও সংশোধন।

৬. নৈতিকতা ও উদাহরণ দ্বারা শিক্ষা

ধর্মীয় নীতিগুলোর কার্যকারিতা এবং প্রাসঙ্গিকতা বাস্তব জীবনের উদাহরণের মাধ্যমে প্রদর্শন করা।
সঠিক নৈতিকতা ও ইসলামি চরিত্র অনুসরণ করে মানুষকে অনুপ্রাণিত করা।

৭. গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা

ভ্রান্তির উৎস চিহ্নিত করে তা দূর করার উপায় বের করতে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য তাদের বোঝার স্তর অনুযায়ী উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান।

৮. অহিংস ও ইতিবাচক পদ্ধতি অনুসরণ

ভ্রান্তি দূর করতে সবসময় অহিংস ও ইতিবাচক পদ্ধতি ব্যবহার করা।
শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী আচরণের মাধ্যমে মানুষকে দাওয়াহ দেওয়া।

৯. একতা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা

ভ্রান্তি দূর করতে আলেম, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং সমাজের সচেতন ব্যক্তিদের সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করা।
বিভিন্ন মতপার্থক্যের ভিত্তিতে বিভক্তির পরিবর্তে ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা।

১০. শরীয়তের শাস্তির (হুদুদ) প্রয়োগ


উপরোক্ত পন্থাগুলোর পাশাপাশি শরীয়তের হুদুদ বা নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইসলামের বিরোধিতায় যারা সরাসরি লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে শরীয়তের আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ইসলামের অটুটতা এবং শুদ্ধতা রক্ষায় অপরিহার্য ।এক্ষেত্রে বিভিন্ন কিতাবাদীতে এই পদক্ষেপটিই উল্লেখ করা হয়েছে।অর্থাৎ হুদূদ বা শাস্তি বিচারের প্রয়োগ করা।

শরীয়তের হুদুদ শাস্তি শুধুমাত্র অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করেই থেমে থাকে না, এটি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মিথ্যাবাদী, কুফরের প্রচারক, এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করা ব্যক্তিদের শাস্তি ইসলামী সমাজের জন্য অপরিহার্য, কারণ এর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর শুদ্ধতা বজায় থাকে।

এই শাস্তির মধ্যে রয়েছে মদপান, ব্যভিচার, মুরতাদদের শাস্তিসহ অন্যান্য হদুদ, যা অপরাধের প্রকারভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এখানে বিশেষভাবে আমরা মুরতাদদের শাস্তি নিয়ে আলোচনা করবো, আশা করি এর মাধ্যমে  পাঠকরা বুঝতে পারবেন, ইসলামে নির্ধারিত শাস্তির মাধ্যমে কীভাবে ইসলামের অটুটতা এবং শুদ্ধতা রক্ষা করা হয়।

মুরতাদের শাস্তি: ইসলামের শুদ্ধতা ও সুরক্ষায় শরীয়তের অটুট বিধান

আল্লাহ তাআলা তাঁর অমিত প্রজ্ঞা ও অবারিত দয়ার মাধ্যমে এমন কিছু বিধান নির্ধারণ করেছেন যা ইসলামকে অটুট রাখতে এবং তার শুদ্ধতা রক্ষা করতে অপরিহার্য। এর মধ্যে অন্যতম হল রেদ্দের শাস্তি, যা ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে, মিথ্যার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বাধা তৈরি করে এবং ইসলামিক বিশ্বাস ও আদর্শকে অটল রাখে। এই বিধান ইসলামী সমাজে মিথ্যাবাদী, কুফরের পতাকা উত্তোলনকারী এবং কুফরের প্রচারকারীদের দমন করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

নবী ﷺ এক সুপরিচিত হাদীসে বলেছেন:

“ যদি কেউ দীন পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়, তবে তোমরা তাকে হত্যা করবে।” 51

এখানে ‘ধর্ম পরিবর্তন’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে ইসলাম ত্যাগ করা। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য, এবং যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে, তার শাস্তি ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী অত্যন্ত কঠোর।

ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই কিভাবে ইসলামের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। যখন আরবের মুরতাদরা ইসলাম ত্যাগ করেছিল, তখন সাহাবী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন এবং ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এমনকি আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যারা তাকে ইলাহিয়াত বিশ্বাস করে সিজদা করতো। তাদের তওবা না করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল।

এটি একটি প্রামাণিক ঘটনা, যেখানে রাসূল ﷺ আবু মুসা আশআরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)কে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, এবং পরে معاذ بن جبل (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে পাঠানো হয়। একদিন, যখন معاذ بن جبل (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ইয়েমেনে পৌঁছালেন, তখন তিনি এক ব্যক্তিকে দেখেন, যিনি একসময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। معاذ بن جبل (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে প্রশ্ন করেন, “এটা কী?” তখন ওই ব্যক্তি জানান, “আমি প্রথমে মুসলিম হয়েছিলাম, কিন্তু পরবর্তীতে আমি ইহুদি হয়ে গিয়েছি।” معاذ بن جبل (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাকে বলেন, “বসো,” কিন্তু আবু মুসা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমি বসব না যতক্ষণ না সে নিহত হবে, কারণ এটি আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর ফয়সালা।”

এভাবেই, আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর নির্দেশনায়, ওই ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, কারণ ইসলাম ত্যাগ করা এবং কুফরী গ্রহণ করা, ইসলামের সবচেয়ে বড় অপরাধ।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে ঘোষণা করেছেন:

“আর যে তোমাদের মধ্য থেকে তাঁর দীন থেকে ফিরে যাবে, অতঃপর কাফির অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, বস্তুত এদের আমলসমূহ দুনিয়া ও আখিরাতে বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং তারাই আগুনের অধিবাসী। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।”52


এটি ছিল আল্লাহ ও রাসূল ﷺ এর ফয়সালা, যা রেদ্দের শাস্তি নির্ধারণ করে। ইসলামের সুরক্ষার জন্য এটি একটি অপরিহার্য বিধান। যদি মুরতাদদের শাস্তি না দেওয়া হতো, তবে ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি সহজেই ধর্ম ত্যাগ করতো। এজন্য আল্লাহ তাআলা রেদ্দের শাস্তি নির্ধারণ করেছেন, যাতে ইসলাম অটুট থাকে এবং কুফরী ও মিথ্যার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে।

ইসলাম রক্ষার জন্য এই বিধান অত্যন্ত জরুরি, এবং তা অনুসরণ করা মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব। আজকাল, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে কুফরী প্রচারের কথা শুনে থাকি—যেমন টেলিভিশন, সিনেমা, বই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম—যেখানে মুরতাদরা তাদের কুফরী প্রকাশ করছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে শাস্তি কার্যকর না হওয়া ইসলামকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অতএব, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী রেদ্দের শাস্তি পুনরায় কার্যকর করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে ইসলাম এবং মুসলিম উম্মাহ রক্ষা পায়।

আমরা আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আমাদের অন্তরকে আলোকিত করুন এবং আমাদেরকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমরা তাঁর কাছে দোয়া করি, তিনি মুসলিম উম্মাহকে শক্তি দিন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

দ্বীন সুরক্ষার উপরাক্ত তিনটি উপাদান তথা  1.দ্বীনের প্রতি আহ্বান 2. দ্বীনের বিরোধিতাকারী ও  দ্বীন ধংসের অপচেষ্টকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ 3.দ্বীনের প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোর ক্ষেত্রে সৃষ্ট ক্ষতির প্রতিকার। এগুলো হলো ইমাম শাতেবী রহ. এর বক্তব্য অনুসারে । অন্যথায় অন্যান্য ইমামগণ আরো উপাদান উল্লেখ করেছেন । তবে আমরা বলতে পারি মৌলিক উপাদান তিনটি যা আমরা এতক্ষণ আলোচনা করে এসেছি।

জরুরিয়্যাতের পাঁচটি উপাদানের দ্বিতীয়টি হলো: (حفظ النفس): মানুষের জীবন বা আত্মার সুরক্ষা।


ইসলামে “হিফয আন-নাফস” বা প্রাণ রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা, যা ইসলামের মূল উদ্দেশ্যের (مقاصد الشريعة)  প্রথম কাতার রাখা হয়েছে । অর্থাৎ জরুরিয়্যাতের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এটি জরুরিয়্যাতের পাঁচটি উপাদানের মাঝে দ্বিতীয়। এটি মানব জীবনের পবিত্রতা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা সংরক্ষণের প্রতি ইসলামের গুরুত্ব নির্দেশ করে।

(حفظ النفس) বা জীবন সুরক্ষার সংঙ্গা: (Definition)

হিফযুন নাফস বলতে বোঝায় মানুষের জীবন, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও গৌরবের সুরক্ষা।53

علم المقاصد الشرعية، نور الدين الخادمي، ص81.

 এটি ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্যগুলোর অন্যতম। আল্লাহ তাআলা মানুষের মর্যাদাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন: “আমি আদাম সন্তানকে সম্মানিত করেছি ” 54

অন্য আয়াতে তিনি আরও ইরশাদ করেছেন: “অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম গঠনে “55

 এই আয়াতগুলো মানুষের মর্যাদা ও সুরক্ষার গুরুত্ব স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

 অনেকে বলেছেন হিফযুন নাফস অর্থাৎ প্রাণের সংরক্ষণ হলো জীবনের সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে প্রাণীকুলকে কল্যাণকর গুণাবলীর মাধ্যমে উৎকর্ষিত করা হয় এবং তাদের থেকে সব ধরনের ক্ষতিকর দোষ ও অপকর্ম দূরে রেখে তাদের মঙ্গল নিশ্চিত করা হয়।

(حفظ النفس) প্রাণ সংরক্ষণের গুরুত্ব

ইসলামে মানব জীবনের মর্যাদাকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, এটি সংরক্ষণ ইসলামী আইনের মৌলিক পাঁচটি উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত । কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:


 “যে ব্যক্তি কোনো প্রাণকে হত্যা করে অন্য প্রাণের প্রতিশোধ হিসেবে বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি ছাড়া, সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোনো প্রাণকে রক্ষা করল, সে যেন সমস্ত মানবজাতিকে রক্ষা করল।” 56

এই আয়াত প্রাণের গুরুত্ব ও তা রক্ষার দায়িত্বের ওপর জোর দেয়। এটি বোঝায় যে, একজন মানুষের জীবনও সম্পূর্ণ মানবজাতির সমান গুরুত্বপূর্ণ।  সুতরাং নফস (জীবন) ইসলামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত, এবং ইসলাম এই অধিকার রক্ষা করতে নানা বিধান প্রদান করেছে। আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবন ও সুরক্ষার জন্য কিছু বিশেষ নিয়মাবলী বা বিধান নির্ধারণ করেছেন, যা আমাদের জীবনের মূল্য ও গুরুত্ব প্রতিফলিত করে।

আমরা এখানে মৌলিক কিছু বিধান উল্লেখ করছি:

১. নিরপরাধ ব্যক্তির হত্যার শাস্তি (কিসাস)
আল্লাহ তাআলা নিরপরাধ ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করার শাস্তি হিসেবে কিসাস (প্রতিশোধ) বিধান করেছেন। তবে, যদি হত্যার শিকার ব্যক্তি বা তার স্বজনরা ক্ষমা করে দেন, তবে শাস্তি মাফ হতে পারে। এটি মানব জীবনের সুরক্ষা এবং ক্ষমার গুরুত্বকে সামনে আনে।

২. ভুলক্রমে হত্যা করা (দিয়্যাত)
যদি কেউ ভুলক্রমে কোনো মুসলিমকে হত্যা করে, তবে তাকে দিয়্যাত (অর্থদণ্ড) প্রদান করতে হবে। ইসলামে মুসলিমের রক্তের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি, এমনকি ভুল করেও যদি কোনো মুসলিমের জীবন শেষ হয়ে যায়, তখন তা আরেকটি কারণে শাস্তিযোগ্য।

৩. জরুরি অবস্থায় নিষিদ্ধ বস্তু হালাল হওয়া
আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, যদি কোনো পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি হয়, তাহলে কিছু নিষিদ্ধ বস্তু যেমন মৃত প্রাণী বা মদ খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তবে এটা শুধুমাত্র জীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হতে হবে।

৪. জীবন রক্ষার্থে কুফরি কথা বলা

যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবন রক্ষার জন্য এমন পরিস্থিতিতে পড়েন যেখানে তাকে কুফরি কথা বলতে হয়, তবে সে তা বলতে পারবে, তবে তার অন্তরে অবশ্যই পূর্ণ ঈমান থাকতে হবে। ইসলাম, মানুষের জীবন রক্ষার জন্য শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমার রাস্তা দেখিয়েছে।

৫. জীবন রক্ষা করতে প্রতিরোধ ও শহাদত
ইসলামিক শরিয়তে জীবন রক্ষার গুরুত্ব আরো স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আল্লাহ তাআলা অনুমতি দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি আক্রান্ত হবে, সে তার জীবন রক্ষার্থে প্রতিরোধ করতে পারবে, এবং যদি তাতে মৃত্যু ঘটে, তবে তাকে শহীদ হিসেবে গণ্য করা হবে।

রাসূল ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার রক্ত রক্ষার জন্য নিহত হবে, সে শহীদ” 57

 বিস্তারিত পড়ুন

আর-রিসালাতুল নাদিয়্যাহ ফিল ক্বাওয়াদিল ফিক্বহিয়্যাহ, আব্দুল ফাত্তাহ মুসিলহি, পৃ. 27 থেকে

(حفظ النفس) বা জীবন সংরক্ষণের ভিত্তি

(حفظ النفس) বা জীবন সংরক্ষণ মূলত তিনটি মূল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। সেগুলো হলো:

১. প্রজনন বিধান অনুযায়ী তার মূল অস্তিত্ব রক্ষা করা: এটি (حفظ النفس)  মানব জীবনের প্রথম মৌলিক স্তর, যেখানে সঠিক প্রজনন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।

২. অস্তিত্ব লাভের পর তার পরিপূর্ণতা রক্ষা করা: একবার মানুষ সৃষ্টি হয়ে গেলে তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষা করা জরুরি। খাদ্য, পানীয়, পোশাক এবং বাসস্থান মানুষের জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ। এছাড়া, তাকে এমন কিছু থেকে সুরক্ষিত রাখা যা তার শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

৩. হারাম থেকে সুরক্ষা: ইসলাম মানুষকে যে সকল হারাম কাজ থেকে দূরে রাখতে চায়, যেমন ব্যভিচার, মদ্যপান বা গাঁজা সেবন, তা তার আত্মরক্ষার অংশ। সঠিক বিবাহ ব্যবস্থা, শালীনতা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ এইসব হারাম কাজ থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথ প্রদর্শন করে।


এই সমস্ত বিষয়ের মৌলিক ভিত্তি কুরআনে উল্লেখিত এবং সুন্নাহর মাঝে এর বিশদ ব্যাখ্যা করেছে এবং এইসব বিষয়ের পূর্ণতা আসে তিনটি উপায়ে।  যা হল:

১. সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক: সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যেমন তালাক, খুলা, লিয়ান, ইত্যাদি, যা আত্মরক্ষার অংশ।
২. খাদ্য ও পানীয়: যা কিছু শরীরের জন্য ক্ষতিকর, বিষাক্ত বা মরণঘাতী, তা থেকে তাকে সুরক্ষিত রাখা।
৩. প্রয়োজনীয় শারীরিক ও আইনগত নিরাপত্তা: পশু হত্যা, শিকার, হদ্দ, কিসাস এবং অন্যান্য শারীরিক বিপদ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।58




বিস্তারিত পড়ুন

কিতাবুল মুআফাকাত, ইমাম শাতেবী

জরুরিয়্যাতের পাঁচটি উপাদানের তৃতীয়টি হলো: (حفظ النسل): পরিবার ও বংশের সুরক্ষা।

ইসলাম পরিবার ও বংশের সুরক্ষার প্রতি গভীর গুরুত্ব দিয়েছে। শরিয়তের পরিভাষায় যা حفظ النسل বা প্রজন্মের সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ হিসেবে পরিচিত। এটি ইসলামের মূল উদ্দেশ্যসমূহের প্রথম ভাগ “জরুরিয়্যাত”-এর অন্তর্ভুক্ত এবং মানবজাতির অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই মহান উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে ইসলাম মানবপ্রকৃতির প্রতি এক দয়ালু ও প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে।

ইসলাম বিয়ে, পরিবার ও সন্তান পালনের ক্ষেত্রে এমন আদর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা শুধুমাত্র মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য নয়, বরং একটি সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ ও নৈতিক সমাজ গঠনের জন্যও অপরিহার্য। এটি পৃথিবীতে শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি আনার একটি অমূল্য পন্থা। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে যে, পরিবার ও প্রজন্মের পরিচর্যা কেবল মানবিক কর্তব্য নয়, বরং এটি আমাদের পরকালীন সফলতার দিকে একটি পবিত্র পদক্ষেপ, যা আমাদের জীবনকে প্রজ্ঞা এবং আলোকিত পথের দিকে পরিচালিত করে।

সন্তানদের সঠিক শিক্ষা, আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রদান করে আমরা শুধু তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি তা নয়, বরং এক সুশৃঙ্খল, নৈতিক ও উন্নত সমাজের ভিত্তি স্থাপন করতে পারি।

এভাবে, ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি দিকেই সুশৃঙ্খলা, সহানুভূতি ও নৈতিকতার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অমূল্য নির্দেশিকা প্রদান করেছে, যা মানবজাতির কল্যাণ ও শান্তির জন্য চিরকাল প্রযোজ্য। এখন আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করবো, (حفظ النسل) বা বংশবিস্তার নিশ্চিতকরণে ইসলাম কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

মানব বংশধারা সংরক্ষণে ইসলামের অমূল্য অবদান


মানবজাতির অস্তিত্ব ও উত্তরাধিকার সুরক্ষিত রাখা ইসলামের অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য। ইসলাম চায়, মানবজাতি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করে নিরবচ্ছিন্নভাবে টিকে থাকুক। আল্লাহ তা’আলা যখন এই পৃথিবীর অবসান ঘটাবেন, তখন পর্যন্ত মানবজাতি যেন তাঁর নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে পারে। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইসলাম অসংখ্য নীতিমালা ও বিধান প্রণয়ন করেছে, যা মানবজীবনকে শৃঙ্খলিত ও সমৃদ্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১. বিবাহের বিধান

ইসলাম বিবাহকে বৈধ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি শুধুমাত্র প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মাধ্যম নয়, বরং মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা এবং একটি নৈতিক সমাজ গঠনের পবিত্র মাধ্যম। বিবাহের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানরা আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে। তারা পরবর্তী প্রজন্মকে সেই দায়িত্ব হস্তান্তর করে মানবসমাজের উন্নতি ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।

২. সন্তানদের লালন-পালন ও পরিবার গঠন

ইসলাম পিতামাতাকে তাদের সন্তানদের সঠিকভাবে লালন-পালনের দায়িত্ব দিয়েছে। সন্তানদের শৈশব ও কৈশোরে যত্ন ও শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে দায়িত্বশীল ও নৈতিক নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। পরিবার, যা মানবজাতির প্রাথমিক আশ্রয়স্থল, তার গুরুত্ব ইসলাম বিশেষভাবে দিয়েছে। বিবাহে সঠিক পছন্দ ও পারস্পরিক সম্মতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ইসলাম একটি সুখী ও সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক পরিবারকে স্থিতিশীল রাখে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

 “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। “
(সূরা রূম: ২১)


৩. নৈতিক ও শালীন সম্পর্কের আদর্শ

পুরুষ ও নারীর মধ্যে সম্পর্কের পবিত্রতা ও শালীনতা রক্ষার জন্য ইসলাম স্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • একে অপরের প্রতি দৃষ্টি সংযত রাখা।
  • শালীন পোশাক পরিধান করা, যা ফিতনা ও অশালীনতার পথ রোধ করে।
  • মাহরাম ছাড়া কোনো নারী-পুরুষের নির্জনে একাকী অবস্থান নিষিদ্ধ।
  • বাড়িতে প্রবেশের সময় অনুমতি ও সালামের বিধান পালন করা।


আল্লাহ তা‘আলা বলেন:


 “হে মুমিনগণ, তোমরা নিজদের গৃহ ছাড়া অন্য কারও গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।”59


৪. অবৈধ সম্পর্ক ও অপবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

ইসলাম ব্যভিচার ও মিথ্যা অপবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ব্যভিচার সমাজের নৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে এবং মানব বংশধারার বিশুদ্ধতা নষ্ট করে। তাই ইসলাম ব্যভিচারকে হারাম করেছে এবং এর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি, মিথ্যা অপবাদ দেয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এর জন্যও শাস্তির বিধান দিয়েছে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:


 “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী – নারী ও পুরুষ প্রত্যেককে একশ’ কশাঘাত করবে, আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মু’মিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। “60


অন্য এক আয়াতে তিনি বলেন:


 “আর যারা সচ্চরিত্র নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে আসে না, তবে তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত কর এবং তোমরা কখনই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না। আর এরাই হলো ফাসিক। “61


ইসলামের এই নীতিমালা ও বিধান মানবজাতির বংশধারা সংরক্ষণ, নৈতিকতা বজায় রাখা এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও সুস্থ সমাজ গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করে। এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন সমাজে শালীনতা, নিরাপত্তা ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করে। এক কথায়, ইসলাম মানবজীবনকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুশৃঙ্খল জীবনব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলেছে, যেখানে ব্যক্তির জীবন থেকে শুরু করে পুরো সমাজ পর্যন্ত সবকিছু সুরক্ষিত ও উন্নত।62

চতুর্থটি হলো: (حفظ العقل) মানসিক ও বুদ্ধিগত ক্ষমতার সংরক্ষণ বা জ্ঞান ও মস্তিষ্কের সুরক্ষা।

ইসলামে বুদ্ধিমত্তা (আক্‌ল) অত্যন্ত মর্যাদা এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে বিবেচিত ।এটি মানবজাতির জন্য আল্লাহর এক অমূল্য দান, যা মানুষের দায়িত্বশীলতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষ ‘আশরাফুল মাখলূকাত’ আল্লাহর সেরা সৃষ্টির মর্যাদা লাভ করেছে এবং অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে তার বিশেষ স্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আক্‌ল শুধুমাত্র মানুষের চিন্তা-ধারা এবং কর্মের নির্দেশক নয়, বরং এটি আল্লাহর খিলাফতের (প্রতিনিধিত্ব) দায়িত্ব পালনে মানবজাতির উপযুক্ততা নিশ্চিত করে।

আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন:

“নিশ্চয় আমি আসমানসমূহ, যমীন ও পর্বতমালার প্রতি এ আমানত পেশ করেছি, অতঃপর তারা তা বহন করতে অস্বীকার করেছে এবং এতে ভীত হয়েছে। আর মানুষ তা বহন করেছে।”63

ইসলাম মস্তিষ্কের সুরক্ষা এবং বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এবং বুদ্ধিমত্তার সংরক্ষণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা মানবজীবন, সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। এই নীতিমালা মানুষের ব্যক্তিগত উন্নতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং বৈশ্বিক শান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিম্নে কয়েকটি নীতিমালা উল্লেখ করা হলো:

১. মদ ও মাদক নিষিদ্ধকরণ:

ইসলাম মস্তিষ্কের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে এমন সব কিছু নিষিদ্ধ করেছে, যেমন মদ এবং মাদক। আল্লাহ বলেন:


“হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। “64

২. শাস্তি ও প্রতিকার:

বুদ্ধিমত্তাকে রক্ষা করতে ইসলাম মদ ও মাদকসেবনের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেছে। এর মাধ্যমে সমাজে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব রোধ করা এবং মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব হয়েছে।

৩. যুক্তিক চিন্তা করতে এবং অযৌক্তিক বিশ্বাস থেকে বিরত থাকতে উৎসাহ প্রদান

ইসলাম মানুষের মস্তিষ্ককে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে এবং যুক্তির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছে। এটি মানুষকে প্রমাণের অনুসন্ধান করতে এবং অযৌক্তিক বিশ্বাস থেকে বিরত থাকতে শিখিয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তারা কি তাঁকে ছাড়া অনেক ইলাহ গ্রহণ করেছে? বল, ‘তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আস। আমার সাথে যারা আছে এটি তাদের জন্য উপদেশ এবং আমার পূর্বে যারা ছিল তাদের জন্যও এটাই ছিল উপদেশ।’ কিন্তু তাদের বেশীরভাগই প্রকৃত সত্যকে জানে না; তাই তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়।”65


এভাবে ইসলাম মানুষকে শুধুমাত্র আবেগ বা অন্ধবিশ্বাসের ভিত্তিতে চলার পরিবর্তে যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়েছে।

৪. শারীরিক ও মানসিক বিকাশে উৎসাহ প্রদান

ইসলাম শারীরিক ও মানসিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখতে এবং জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানসিক বিকাশ সাধন করতে উত্সাহিত করেছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:


 “বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে “66


এছাড়া, ইসলামে বিচারককে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রায় দিতে নিষেধ করা হয়েছে, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ মস্তিষ্কের ব্যবহার নিশ্চিত হয়।

৫. বুদ্ধিমত্তার সম্মান:

ইসলাম বুদ্ধিমত্তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করেছে এবং বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানীদের বিশেষ সম্মান প্রদান করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যারা মনোযোগ সহকারে কথা শোনে অতঃপর তার মধ্যে যা উত্তম তা অনুসরণ করে তাদেরকেই আল্লাহ হিদায়াত দান করেন আর তারাই বুদ্ধিমান “67  সূরা আয-যুমার  , আয়াত 18

এতে বোঝানো হয়েছে যে, সত্যের অনুসরণকারী ও জ্ঞানী ব্যক্তিরাই প্রকৃত সফলতা লাভ করে।

৬. কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার বিরোধিতা:

ইসলাম মস্তিষ্ককে কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার প্রভাব থেকে মুক্ত করতে এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয়। এ কারণে ইসলাম যাদু, ভবিষ্যৎবাণী, টোটেম ও অন্যান্য ভ্রান্ত বিশ্বাসের নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম মস্তিষ্ককে এমন গায়েবি বিষয়গুলোতে বিতর্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছে, যেগুলোর কোনো প্রমাণ বা সত্যতার ভিত্তি নেই, কারণ এগুলো কেবল অহংকার সৃষ্টি করে এবং মানুষের চিন্তা-শক্তির অপচয় ঘটে। আল্লাহ তাআলা বলেন:


নিশ্চয় যারা তাদের নিকট আসা কোন দলীল- প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বিতর্ক করে, তাদের অন্তরসমূহে আছে কেবল অহঙ্কার, তারা কিছুতেই সেখানে (সাফল্যের মনযিলে) পৌঁছবে না। কাজেই তুমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।68

অন্য আযাতে আল্লাহ তাআলা বলেন:


“আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না “69

৭. যুক্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনা ও সত্য অনুসন্ধানে উৎসাহ প্রদান:

ইসলাম মানুষকে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা এবং সত্যের অনুসন্ধানে উৎসাহিত করে। এ ক্ষেত্রে  ইসলাম দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় শিক্ষা দেয়:

  • সঠিক যুক্তির অনুসরণ: বিশ্বাস স্থাপনের পূর্বে ‍যুক্তির আলোকে নিরীক্ষণ করে দেখা। এটি মানুষকে বিশ্বাস স্থাপনে সহায়তা করে। অর্থাৎ অমুলক যাবতীয় বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে নিষেধ করেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের শিখিয়েছেন যে, বিশ্বাস স্থাপনের আগে তা ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
    “এরা আমাদেরই স্ব-জাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, তার চাইতে অধিক গোনাহগার আর কে?70
  • সৃষ্টির রহস্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা: , ইসলাম মানুষকে মহাবিশ্বের নিয়মাবলী এবং প্রকৃতির সূক্ষ্মতা নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছে।এই চিন্তা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকৃতির নিখুঁত সম্পর্ক ও সুষমা বুঝে নিশ্চিত জ্ঞান লাভের পথ সুগম হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নির্দশন”71 

৮. শরিয়তের বিধানের হিকমত ও রহস্য উদ্‌ঘাটন

ইসলাম মানুষকে শরিয়তের বিধানের গভীরে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে। এর মাধ্যমে মানুষের মন ও হৃদয় খুলে যায় এবং তারা আল্লাহর রাহে চলার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।

 আল্লাহ তাআলা বলেন:


“তারা কি কুরআনের মর্ম বিষয়ে চিন্তে-ভাবনা করে না? যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তাতে তারা অবশ্যই বহু অসঙ্গতি পেত। “72

এটি মানুষের মস্তিষ্ককে ইসলামে বার্তা এবং তার বিধানকে গভীরভাবে অনুধাবন ও চিন্তা করার দিকে উৎসাহিত করে।

৯. মানব সভ্যতা গঠনে বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার

 ইসলাম মানুষকে পৃথিবী ও তার প্রাকৃতিক শক্তি থেকে উপকৃত হয়ে বুদ্ধিমত্তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানব সভ্যতা গঠনে উৎসাহিত করেছে। এই বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বস্তুগত শক্তি অর্জন এবং সমাজের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:


তিনি তোমাদের জন্য যমীনকে (তোমাদের ইচ্ছার) অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা তার বুকের উপর দিয়ে চলাচল কর, আর আল্লাহর দেয়া রিযক হতে আহার কর, পুনরায় জীবিত হয়ে তাঁর কাছেই যেতে হবে।”73

১০. ইজতিহাদের দরজা উন্মুক্ত রাখা

ইসলাম নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে ইজতিহাদ বা যুক্তি ও প্রমাণের মাধ্যমে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ রেখেছে। এটি মুসলিম সমাজকে আধুনিক যুগের প্রয়োজনীয়তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ন্যায়বিচারের মূল নীতির উপর ভিত্তি করে কাজ করার সুযোগ প্রদান করেছে।

এইভাবে ইসলাম মস্তিষ্কের সুরক্ষা, বিকাশ এবং উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য নানা বিধান ও শিক্ষা প্রদান করেছে, যাতে মানবজাতি আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলতে পারে এবং পৃথিবীতে শান্তি ও উন্নতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সুতরাং সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, ইসলাম বুদ্ধিমত্তার সংরক্ষণ এবং বিকাশের জন্য সুসংহত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা ব্যক্তি, সমাজ এবং সভ্যতার জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই নীতিমালাগুলো মাধ্যমে মানুষকে যুক্তিবাদী, সৃজনশীল ও দায়িত্বশীল জীবনের পথে পরিচালিত করে। ইসলামের এই শিক্ষা সমাজে আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য এবং একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 

পঞ্চমটি হলো: (حفظ المال): আর্থিক সম্পদ বা মৌলিক চাহিদাগুলোর সংরক্ষণ।


ইসলাম মানবজাতির প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি সর্বদা সহানুভূতিশীল। মানুষের জন্মগত সম্পদ অর্জনের চাহিদাকে একদিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, অন্যদিকে এই চাহিদা যেন প্রবৃত্তিতে রূপান্তরিত হয়ে সমাজে বৈষম্য বা অনৈতিকতার কারণ না হয়, সে জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যাকাত, উত্তরাধিকার আইন এবং সামাজিক নিরাপত্তার মতো ব্যবস্থাগুলো সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন নিশ্চিত করে। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ শুধু ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের মাধ্যম নয়, বরং মানবজীবনের এক অপরিহার্য উপাদান। তাই ইসলাম বৈধ পথে সম্পদ উপার্জন, সঞ্চয়, সুরক্ষা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং ন্যায্য বণ্টনের জন্য নানামুখী নির্দেশনা প্রদান করেছে। নিম্নে আমরা ইসলামে সম্পদ উপার্জনের বৈধ পদ্ধতি এবং সম্পদ সংরক্ষণের পন্থা বিষয়ক কিছু নীতিমালা তুলে ধরছি ।

প্রথমত, ইসলামে সম্পদ উপার্জনের বৈধ পদ্ধতি বিষয়ক কিছু নীতিমালা:

১. জীবিকা উপার্জনে পরিশ্রমের গুরুত্ব

ইসলাম জীবিকা অর্জনকে একটি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছে। বৈধ পন্থায় এবং সৎ উদ্দেশ্যে উপার্জিত সম্পদ শুধু জীবনের প্রয়োজন মেটায় না, বরং ইবাদতের মর্যাদা পায়।

আল্লাহ তাআলা বলেন:


“তিনি তোমাদের জন্য যমীনকে (তোমাদের ইচ্ছার) অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা তার বুকের উপর দিয়ে চলাচল কর, আর আল্লাহর দেয়া রিযক হতে আহার কর, পুনরায় জীবিত হয়ে তাঁর কাছেই যেতে হবে।” 74


অন্যত্র তিনি আরও বলেন:


“সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।” 75

২. শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণ

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:


“নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাঊদ (আঃ) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। “76


ইসলাম প্রত্যেক মানুষের জন্য কাজের সুযোগ নিশ্চিত করেছে। যারা কাজ পায় না তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে ঘোষণা দিয়েছে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষা ও তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদানে ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।”77


তিনি আরও বলেন, আল্লাহ বলেন:
“তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমি কিয়ামতের দিন অভিযোগকারী হব:
১) যে আমার নামে চুক্তি করে এবং প্রতারণা করে,
২) যে একজন মুক্ত মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য গ্রহণ করে,
৩) যে একজন শ্রমিককে কাজ করিয়ে তার পারিশ্রমিক দেয় না।”78


৩. ন্যায়সঙ্গত লেনদেন ও বৈধ চুক্তি

ইসলাম ন্যায়বিচারপূর্ণ লেনদেনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। এমন সব চুক্তি বৈধ করা হয়েছে যা কোনো পক্ষের প্রতি অন্যায় বা শোষণের কারণ হয় না। বিক্রয়, ভাড়া, বন্ধক, অংশীদারি ইত্যাদি চুক্তি অনুমোদিত হয়েছে, তবে শর্ত হলো সেগুলোতে উভয় পক্ষের অধিকার সুরক্ষিত থাকতে হবে। তদুপরি, নতুন উদ্ভাবিত চুক্তিও অনুমোদিত, যদি সেগুলো অন্যায় বা অবিচারের শিকার না হয়।

দ্বিতীয়ত, সম্পদ সংরক্ষণের পন্থা বিষয়ক কিছু নীতিমালা:


 সম্পদ সংরক্ষণের উপায় এবং ইসলামের নির্দেশিত নীতিগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:

১. সম্পদের সঠিক ও বৈধ ব্যবহার

ইসলাম সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা এবং সামগ্রিক কল্যাণের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন যেমন সুদ, চুরি বা প্রতারণা, এগুলো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।”79

তদুপরি, অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভক্ষণ করো না।”80


২. অন্যের সম্পদে অবৈধ অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ

ইসলামে চুরি, ডাকাতি বা প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ দখল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ ধরনের অপরাধ দমন করতে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:


“আর পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও তাদের অর্জনের প্রতিদান ও আল্লাহর পক্ষ থেকে শিক্ষণীয় আযাবস্বরূপ এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”81


এছাড়া, কারও সম্পদ ধ্বংস করা হলে দোষীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:


” কোন মুসলিমের উপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইযযত-আবরু হারাম।”82


৩. অপ্রয়োজনীয় খরচ নিষিদ্ধকরণ ও সঠিক পথে ব্যয়ের নির্দেশ


ইসলাম অর্থ অপচয় ও বিলাসিতাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং সৎ ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম বলে, সম্পদ আল্লাহর দান, এবং মানুষ তার একজন তত্ত্বাবধায়ক।

আল্লাহ বলেন:

“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং তিনি তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন, তা থেকে ব্যয় কর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিফল।”83

অন্যত্র আল্লাহ বলেন:

“আল্লাহ তোমাদেরকে যে মাল দিয়েছেন তাত্থেকে তাদেরকে দান কর।”84

অপব্যয় সমাজে অহংকার ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, যা ধ্বংস ডেকে আনে।

যেমন আল্লাহ বলেছেন:

আর যখন আমি কোন জনপদ ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন তার সম্পদশালীদেরকে (সৎকাজের) আদেশ করি। অতঃপর তারা তাতে সীমালঙ্ঘন করে। তখন তাদের উপর নির্দেশটি সাব্যস্ত হয়ে যায় এবং আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করি।”85

অপব্যয় ও বিলাসিতার পরিত্যাগ এবং সৎ উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয়ের জন্য ইসলামী শিক্ষা আমাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দেয়। আল্লাহর দেওয়া সম্পদ সঠিক পথে ব্যয় করা আমাদের দায়িত্ব, যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং দেশ উভয়ের জন্য কল্যাণকর। তাই মুসলমানদের উচিত, তাঁদের ধন-সম্পদ শুধুমাত্র নিজেদের উপকারে নয়, বরং সমাজের কল্যাণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করা, যাতে সত্যিকার অর্থে একটি ন্যায়সঙ্গত ও সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।


৪. অক্ষমদের সম্পদ রক্ষা

ইসলাম এতিম, নাবালক ও অক্ষমদের সম্পদ সুরক্ষার জন্য বিশেষ বিধান রেখেছে। তাদের সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য অভিভাবক নিয়োগ করা হয়।

আল্লাহ বলেন:


“আর তোমরা ইয়াতীমদেরকে পরীক্ষা কর যতক্ষণ না তারা বিবাহের বয়সে পৌঁছে। সুতরাং যদি তোমরা তাদের মধ্যে বিবেকের পরিপক্কতা দেখতে পাও, তবে তাদের ধন-সম্পদ তাদেরকে দিয়ে দাও। আর তোমরা তাদের সম্পদ খেয়ো না অপচয় করে এবং তারা বড় হওয়ার আগে তাড়াহুড়া করে।”86


অন্যত্র তিনি বলেন:


“আর তোমরা নির্বোধদের হাতে তোমাদের ধন-সম্পদ দিও না, যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্য করেছেন জীবিকার মাধ্যম এবং তোমরা তা থেকে তাদেরকে আহার দাও, তাদেরকে পরিধান করাও এবং তাদের সাথে উত্তম কথা বল।”87

 সুতরাং ইসলাম এতিম, নাবালক ও অক্ষমদের সম্পদ রক্ষার জন্য কঠোর বিধান রেখেছে, যাতে তাদের অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। অভিভাবকদের কর্তব্য, তারা যেন এই সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা করে এবং ন্যায্যভাবে তা তাদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। আল্লাহর নির্দেশিত পথে এগিয়ে গিয়ে, সমাজে একে অপরের অধিকার রক্ষা করা এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব।

এটি একটি পরিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি, যেখানে দুর্বল ও অক্ষমরা নিরাপদ এবং সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে পারে।



৫. ন্যায়সঙ্গত লেনদেন

লেনদেনের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। জুয়া ও প্রতারণামূলক লেনদেন নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন:


“হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।”88

ইসলামী অর্থনীতিতে ন্যায়সঙ্গত লেনদেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সমাজে শান্তি এবং আর্থিক সমতার প্রতিষ্ঠা করে। প্রতারণা, জুয়া ও অন্যায় লেনদেন থেকে বিরত থাকলে সমাজে সৎ ব্যবসা ও আন্তরিক সম্পর্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা সবার কল্যাণে সহায়ক।



৬. সম্পদের বৃদ্ধি ও সঞ্চালন

ইসলাম সম্পদ বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ ও সঞ্চালনকে উৎসাহিত করেছে। সম্পদ জমা করে রেখে (কন্ঠার) অপ্রয়োজনীয় সঞ্চয়কে নিন্দা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন:


“আর তারা আল্লাহর পথে বাধা দেয় এবং যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।”89


 সুতরাং, ইসলামের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু সম্পদ উপার্জন ও রক্ষা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার, সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সামগ্রিক মানবকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য উদ্দীপ্ত করে। ইসলামের এ ব্যবস্থাপনা একটি ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনের পথে আলোকবর্তিকা স্বরূপ।

মোট কথা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পাঁচটি  — ধর্ম, আত্মা, ধন-সম্পদ, বুদ্ধি এবং বংশ ও পরিবার — যেগুলো সমাজের স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ চলাচল এবং মানব জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইসলামী শরীয়াহ এই পাঁচটি মৌলিক বিষয় রক্ষার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছে, যাতে সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্বিতীয়টি হলো:  حاجيات (Necessary)   “হাজিয়্যাত” বা প্রয়োজনীয়।

  অর্থাৎ: শরীয়ত মানুষের প্রয়োজনগুলোকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি হলো  حاجيات (Necessary) —  “হাজিয়্যাত” বা প্রয়োজনীয়।

ইতিপূর্বে জরুরিয়্যাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এখন “হাজিয়্যাত” এর আলোচনা শুরু হচ্ছে।

“হাজিয়্যাত”: সংজ্ঞা ও প্রাসঙ্গিকতা

হাজিয়্যাত বলতে বোঝায় এমন প্রয়োজনীয় বিষয়, যা মানুষের জীবন থেকে কষ্ট ও জটিলতা দূর করতে সহায়ক। এগুলো না থাকলে জীবনের মৌলিক কাঠামো বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হবে না । তবে মানুষের জীবন অসুবিধা ও জটিলতায় পড়বে। হাজিয়্যাতের বিধানগুলো মানবজাতির অসুবিধা দূর করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে এর বিশেষ করুণা। আর এ জন্যই ইবাদতের বিষয়ে বিব্রতকর অবস্থা এড়াতে অসুস্থ ও মুসাফিরদের জন্য রোজা পরে রাখা, অসুস্থ হলে বসে নামাজ পড়া, পানি না থাকা অবস্থায় তায়াম্মুম করা এবং যানবাহনে থাকা অবস্থায় অসুবিধা হবে বলে কিবলা অভিমুখে নামাজ শুরু করার পর যানবাহন দিক পরিবর্তন করার কারণে কিবলা পরিবর্তন হলেও এভাবেই নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।এমনিভাবে মুআমালাতের ক্ষেত্রে বাইয়ে সালাম, ইসতিসনাসহ ইত্যাদির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চলুন আমরা একটু বিশদভাবে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি।

ইবাদতের ক্ষেত্রে  হাজিয়্যাতের প্রতিফলন:

ইবাদতের ক্ষেত্রে হাজিয়্যাতের বিধানগুলো এমনভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যা একজন ব্যক্তির শারীরিক বা মানসিক অসুবিধা দূর করে। উদাহরণস্বরূপ:

  • রোজার ক্ষেত্রে:

অসুস্থ ব্যক্তি বা মুসাফিরকে রোজা ভাঙার বা পরে কাজা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ বলেন:


“আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। “90

নামাজের ক্ষেত্রে:

  • অসুস্থ ব্যক্তিকে বসে অথবা শুয়ে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
  • পানি না পেলে তায়াম্মুমের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জনের বিধান রয়েছে।
  • যানবাহনে থাকা অবস্থায় নামাজের কিবলার দিকে শুরু করে, যাতায়াতের কারণে কিবলা পরিবর্তন হলেও নামাজ অব্যাহত রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।


রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:


“যখন আমি তোমাদের কোনো কাজের নির্দেশ দিই, তখন তোমরা তা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী করো।”91

মুআমালাতের ক্ষেত্রে হাজিয়্যাতের প্রতিফলন:

মুআমালাতের ক্ষেত্রে হাজিয়্যাতের বিধানগুলো মানুষের লেনদেন ও সামাজিক সম্পর্ক সহজ করার জন্য প্রবর্তিত হয়েছে। যেমন:

  • বাইয়ে সালাম (অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়): যেখানে ক্রেতা অগ্রিম অর্থ প্রদান করে এবং বিক্রেতা পরবর্তীতে নির্ধারিত পণ্য সরবরাহ করে।
  • ইসতিসনা (উৎপাদনের চুক্তি): যেখানে কোনো পণ্য তৈরির চুক্তি করা হয়।

এগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যের জটিলতা দূর করা এবং সহজাত প্রয়োজন মেটানো।
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা পরস্পরের মধ্যে পণ্যবিনিময় করো, তবে তা ন্যায়সঙ্গত হওয়া চাই।”92

ইসলামের প্রতিটি বিধানে আল্লাহর রহমতের প্রতিফলন ঘটে। তিনি মানুষকে কষ্টে ফেলতে চান না, বরং সহজতা আনতে চান। নিম্নলিখিত আয়াতগুলো এই বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট করে:

  • আল্লাহ  তা‘আলা বলেন:

وَمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُم مِّنْ حَرَجٍ     
“এবং আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না।”93

  • তিনি আরও বলেন:

وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
“দীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি।”94

  • আল্লাহ তা‘আলা অন্য এক জায়গায বলেন:

يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
“তোমাদের পক্ষে যা সহজসাধ্য, আল্লাহ তাই ইচ্ছা করেন, আর তোমাদের পক্ষে যা দুঃসাধ্য, তা তিনি ইচ্ছা করেন না।”95

মোটকথা ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যেখানে মানুষের প্রয়োজন ও কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাজিয়্যাতের বিধানগুলো এ বিষয়েরই প্রমাণ। এগুলোর মাধ্যমে আল্লাহ মানবজাতির জন্য সহজতা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জীবনকে সুশৃঙ্খল করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তাঁর নির্দেশনা মেনে চলার চেষ্টা করি।আল্লাহ আমাদের ইসলামের সহজতা ও করুণা বোঝার তাওফিক দান করুন। আমিন

তৃতীয়টি হলো- تحسينيات (Beautifications/Improvements) — “তাহসিনিয়্যাত” বা সৌন্দর্য বর্ধক।

অর্থাৎ: শরীয়ত মানুষের প্রয়োজনগুলোকে প্রথমত তিনটি ভাগে ভাগ করেছে। এর মধ্যে তৃতীয়টি হলো- تحسينيات (Beautifications/Improvements) — “তাহসিনিয়্যাত” বা সৌন্দর্য বর্ধক।

তাহসিনিয়্যাতের সংজ্ঞা

তাহসিনিয়্যাতের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের জীবনকে উন্নত নৈতিকতা, উত্তম আচরণ এবং আল্লাহর নির্দেশিত সৌন্দর্যপূর্ণ আদর্শের সাথে পরিচালিত করা। এটি মানুষের চরিত্র ও সমাজে সৌন্দর্য এবং উন্নত গুণাবলীর প্রতিফলন ঘটায়।

তাহসিনিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য

এটি মানুষের অবস্থাকে উচ্চ নৈতিকতা এবং উত্তম আদর্শের সাথে সঞ্চালিত করে। এটি মিস করা হলে জীবনের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয় না এবং মানুষ কষ্ট ও বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকারও হয় না । তবে বীরত্ব, মহত্ত্ব, নৈতিকতা এবং ভাল প্রকৃতির বিপরীত জীবন চলতে থাকে। শরীয়ত এই উন্নত স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়েছে ইবাদত, লেনদেন, রীতিনীতি এবং শাস্তিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে।

যেমন, ইবাদতের ক্ষেত্রে অঙ্গ ঢেকে রাখা, মসজিদে প্রবেশের সময় ভালো পোশাক পরা এবং স্বেচ্ছায় দান-সদকা, ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া।

লেনদেনের ক্ষেত্রে অপবিত্র বিক্রি থেকে বিরত থাকা, বাড়াবাড়ি না করা ইত্যাদি।

আদত, অভ্যাস বা রীতিনীতি সম্পর্কে, খাওয়া এবং পান করার শিষ্টাচারগুলি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া  হয়েছে। যেমন ডান হাতে খাওয়া। খারাপ খাবার পরিহার করা এবং সৎ ও নৈতিকতা অবলম্বন করা ইত্যাদি।

শাস্তির ক্ষেত্রে, কেসাস বা যুদ্ধে মৃত ব্যক্তিকে বিকৃত করতে নিষেধ করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিভিন্ন দুর্গে ইবাদতরত সন্ন্যাসীদের হত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে।

নিম্নে আমরা কয়েকটি ধাপে তা বিস্তারিত  আলোচনা করার চেষ্টা করেছি।

ইবাদতে তাহসিনিয়্যাত

ইসলামে ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে তাহসিনিয়্যাতের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য নয়, বরং আমাদের আচার-আচরণ, শুদ্ধতা এবং পবিত্রতা বজায় রাখতে প্রেরণা দেয়। ইবাদতের প্রতি সৌন্দর্য এবং শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য ইসলামে কিছু বিশেষ বিধান রয়েছে, যেমন:

১. পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার ক্ষেত্রে:

ইসলাম ইবাদতের সময় শুদ্ধতা এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“হে আদাম সন্তান! প্রত্যেক সলাতের সময় তোমরা সাজসজ্জা গ্রহণ কর…”96

এটি ইঙ্গিত করে যে, মুসলিমদের জন্য ইবাদতের সময় শুদ্ধতা এবং সৌন্দর্য অবলম্বন করা অপরিহার্য। যেমন:

  • ইবাদতের সময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঢেকে রাখা।
  • মসজিদে প্রবেশের সময় সুন্দর পোশাক পরিধান করা।

২. স্বেচ্ছায় দান-সদকা:

ইসলাম শুধু ফরজ ইবাদতই নয়, বরং অতিরিক্ত নফল ইবাদত ও দান-সদকাকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য প্রেরণা দেয় অতিরিক্ত দান-সদকা করার প্রতি।

লেনদেনে তাহসিনিয়্যাত

লেনদেনের ক্ষেত্রে তাহসিনিয়্যাত সৎ ও ন্যায়পরায়ণতার উপর গুরুত্ব দেয়। ইসলামে সৎ লেনদেন এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মূল বিষয় উল্লেখ করা যায়:

১. অপবিত্র লেনদেন এড়ানো:

ইসলামে মদ, মাদক, মৃত প্রাণী, মূর্তি বা অন্য যেকোনো অপবিত্র বস্তুর বিক্রি ও লেনদেন নিষিদ্ধ। এটি ব্যবসায়ের নৈতিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

২. অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এড়ানো:

ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফার জন্য বাড়াবাড়ি না করা, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে প্রতারণা এবং জালিয়াতি থেকে বিরত থাকা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা। ইসলামে মিথ্যা ও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন নিষিদ্ধ, কারণ তা সমাজে অস্থিরতা এবং অশান্তি সৃষ্টি করে।

রীতিনীতি, অভ্যাস এবং শিষ্টাচারে তাহসিনিয়্যাত

ইসলামের জীবনদর্শনে রীতিনীতি, অভ্যাস এবং শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। তাহসিনিয়্যাত (সৌন্দর্য ও শুদ্ধতা) শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণে নয়, বরং অন্তরের শুদ্ধতা, শালীনতা, এবং নৈতিকতার প্রতিফলন হিসেবেও গুরুত্ব পায়। ইসলামে প্রতিটি ক্ষেত্রে সৌজন্য, শিষ্টাচার এবং শালীন আচরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে, যা ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সমাজে শান্তি, সম্পর্কের উন্নতি এবং মানুষের মধ্যে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করে। নিচে এই বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আলোচিত হলো:

১. সুন্দর ভাষা ব্যবহার

ইসলাম মানুষের ভাষাকে শালীন, সৌজন্যমূলক এবং মনোমুগ্ধকর হতে উৎসাহিত করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম।97

এটি আমাদের শেখায় যে, ভাষার সৌন্দর্য শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, বরং এটি অন্তরের শুদ্ধতা ও সদ্ভাবের প্রতিফলন। একজন মুসলিমের মুখের কথা তার অন্তরের আয়না, যা তার চরিত্রের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। তাই ইসলামে কথোপকথনে সৌম্যতা, শালীনতা এবং অন্যের প্রতি বিনয়ী মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

২. শিষ্টাচার ও বিনয়

ইসলাম শিষ্টাচার, বিনয় এবং নম্রতা চর্চা করতে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“আর রাহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদেরকে সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। “98

এটি প্রমাণ করে যে, ইসলাম অহংকার এবং আত্মম্ভরিতা পরিহার করে বিনয়ী মনোভাবের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। বিনয়ী মনোভাব একজন মুসলিমকে সম্মানিত করে এবং তার আত্মাকে আল্লাহর দয়া ও প্রেমে পূর্ণ করে তোলে।

৩. মানবিকতা ও সহানুভূতি

ইসলাম মানুষের মধ্যে সহানুভূতি, দয়া এবং সহমর্মিতা জাগাতে চায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দিব না, কি করলে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পর বেশি সালাম বিনিময় করবে “99

এটি সমাজে শান্তি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মুসলিম যদি সহানুভূতি ও দয়া প্রদর্শন করে, তাহলে তা তার সম্পর্কগুলোকে সুস্থ ও স্থিতিশীল রাখে এবং সমাজে মৈত্রীর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

৪. বিশ্বাসের সঠিক অনুশীলন

ইসলাম শুধু বাহ্যিক আচরণে শিষ্টাচারকে গুরুত্ব দেয় না, বরং অন্তরের বিশুদ্ধতা এবং বিশ্বাসের শুদ্ধতা প্রচারের ওপরও গুরুত্ব দেয়। সঠিক বিশ্বাসই মানুষের কর্ম, আচরণ এবং সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে, যা সমাজের কল্যাণে অবদান রাখে।

৫. পরিশ্রম এবং উপার্জন এর সৎ ব্যবহার

ইসলামে সৎ উপায়ে উপার্জন জীবিকা অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তোলে ধরা হয়েছে।পাশাপাশি উপার্জিত অর্থ কেবল ব্যক্তি নিজে ব্যবহার না করে গরীবদের দান-সদকা করার কথাও বলা হয়েছে। একজন মুসলিম সৎ উপার্জনের মাধ্যমে শুধু নিজেকে নয়, বরং সমাজের প্রতিটি সদস্যের কল্যাণে অবদান রাখতে সক্ষম হয়।

৬. খাওয়া ও পান করার শিষ্টাচার

ইসলামে খাওয়া ও পান করার সময় শিষ্টাচার এবং পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

“তোমাদের কেউ যেন বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ শাইতান বাম হাতে পানাহার করে ।”100

এটি ইসলামের নৈতিকতা এবং শিষ্টাচারের প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করে।

৭. উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা বজায় রাখা

ইসলামে প্রতিদিনের জীবনে সৎ, সদাচরণ এবং নৈতিকতা বজায় রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সৎ ও সদাচরণী মানুষ সমাজে অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় এবং এটি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান বৃদ্ধিতে সহায়ক।

সুতরাং রীতিনীতি, অভ্যাস এবং শিষ্টাচারে তাহসিনিয়্যাত ইসলামের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণ বা শিষ্টাচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্তরের শুদ্ধতা, সৌজন্য এবং নৈতিকতার প্রতিফলন হিসেবে প্রতিটি কর্মে প্রকাশ পায়। ইসলামী তাহসিনিয়্যাত আমাদের জীবনে ন্যায়, শান্তি, এবং সম্পর্কের উন্নতি আনতে সহায়ক। একজন মুসলিম যদি তার জীবনের প্রতিটি দিক, বিশেষত ভাষা, আচরণ, বিশ্বাস এবং কাজের মধ্যে শালীনতা, সৌজন্য ও সৎ উদ্দেশ্য প্রতিফলিত করতে পারে, তবে তা কেবল তার নিজের কল্যাণই নয়, বরং সমগ্র সমাজের কল্যাণে অবদান রাখবে। ইসলামের লক্ষ্য, সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবিকতা এবং ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা, যা সমগ্র সমাজকে সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে।

শাস্তিতে তাহসিনিয়্যাত

শাস্তির ক্ষেত্রেও ইসলামে তাহসিনিয়্যাতের প্রতিফলন ঘটে, যেখানে ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিকতা বজায় রাখার উপর জোর দেওয়া হয়। ইসলামে নির্দিষ্ট শাস্তির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও মানবিক আচরণ বজায় রাখা নির্দেশিত:

১. কেসাস (প্রতিদান) বা যুদ্ধে সীমাবদ্ধতা:

ইসলামে যুদ্ধে নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং ইবাদতরত ব্যক্তিদের হত্যা নিষিদ্ধ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হিওয়া সাল্লাম যখন কোন দিকে সৈন্যদল প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে উপদেশ দিয়ে বলতেন: তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহরই পথে জিহাদ করে যাও। যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, কুফরী করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই তোমরা এই জিহাদ করছো। খেয়ানত করো না, ওয়াদা ভঙ্গ করো না, কারো নাক-কান কেটে বিকৃত করো না, শিশু ও নারীদেরকে হত্যা করো না। অন্য সেনাদল ও বাহিনীকেও এই কথাগুলো শুনিয়ে দিও। আল্লাহ তোমাদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন, তোমাদিগকে নিরাপদে রাখুন। 101

এটি প্রমাণ করে যে, ইসলামে ন্যায় ও মানবিকতা প্রতিটি ক্ষেত্রে বজায় রাখার জন্য নির্দেশনা রয়েছে, এমনকি শাস্তির ক্ষেত্রেও।

সুতরাং তাহসিনিয়্যাত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যা মানুষের জীবনকে সৌন্দর্য, নৈতিকতা এবং উন্নত মানসিকতায় পরিচালিত করে। এটি আমাদের ইবাদত, লেনদেন, রীতিনীতি এবং শাস্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী সৌন্দর্য ও সুশৃঙ্খলতাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে।

তাহসিনিয়্যাতের মাধ্যমে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা এবং মানব জীবনে শরিয়তের গভীর প্রভাব স্পষ্ট হয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সৌন্দর্যপূর্ণ আদর্শ অনুযায়ী জীবন পরিচালনার তাওফিক দিন। আমিন।

উল্লিখিত তিনটি প্রকারের পরিপূরক হিসেবে প্রত্যেকটির সাথে আরেকটি প্রকার যুক্ত হবে। সেটি হলো مكملات (Completeness/Perfections) — “মুকাম্মালাত” বা পূর্ণতা

মুকাম্মালাতের সংজ্ঞা

মুকাম্মালাত শরিয়তের উদ্দেশ্যের একটি অনন্য দিক, যা আগের তিন স্তর — জরুরিয়াত (অত্যাবশ্যকীয়), হাজিয়্যাত (প্রয়োজনীয়) এবং তাহসিনিয়্যাত (সৌন্দর্য বর্ধক) — এর পূর্ণতা আনয়নে সাহায্য করে। এটি এই স্তরগুলোকে আরও কার্যকর ও সুসংহত করার জন্য প্রয়োজনীয়। মুকাম্মালাতের মাধ্যমে শরিয়তের উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন হয় আরও পূর্ণাঙ্গভাবে।

মুকাম্মালাতের বৈশিষ্ট্য

মুকাম্মালাত মূলত আগের তিনটি স্তরের সাথে যুক্ত থেকে তাদের যথাযথ রূপে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।

  • জরুরিয়াতের ক্ষেত্রে: মানুষের মৌলিক প্রয়োজন এবং অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান।
  • হাজিয়্যাতের ক্ষেত্রে: কষ্ট লাঘব ও জীবনের জটিলতাগুলো সহজতর করার জন্য সহায়তা।
  • তাহসিনিয়্যাতের ক্ষেত্রে: নৈতিকতা ও সৌন্দর্যের চর্চাকে আরও দৃঢ় ও সুসংগঠিত করা।

মুকাম্মালাতের প্রতিফলন

ইবাদতের ক্ষেত্রে:

1. নামাজে খুশু-খুজু ধরে রাখা, যা নামাজের মূল উদ্দেশ্যকে আরও অর্থবহ করে তোলে।

2. কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাজবিদ মেনে চলা, যা কুরআন পাঠের সৌন্দর্য এবং গুরুত্বকে বৃদ্ধি করে।

লেনদেনের ক্ষেত্রে:

1. চুক্তি লেখার নির্দেশ, যাতে ভুল-ভ্রান্তি বা দ্বন্দ্ব এড়ানো যায়।

2. সাক্ষীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা, যা লেনদেনের স্বচ্ছতা বজায় রাখে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেন-দেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে। আর তোমাদের মধ্যে একজন লেখক যেন ইনসাফের সাথে লিখে রাখে এবং কোন লেখক আল্লাহ তাকে যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন, তা লিখতে অস্বীকার করবে না। সুতরাং সে যেন লিখে রাখে এবং যার উপর পাওনা সে (ঋণ গ্রহীতা) যেন তা লিখিয়ে রাখে। আর সে যেন তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে এবং পাওনা থেকে যেন সামান্যও কম না দেয়। অতঃপর যার উপর পাওনা রয়েছে সে (ঋণ গ্রহীতা) যদি নির্বোধ বা দুর্বল হয়, অথবা সে লেখার বিষয়বস্ত্ত বলতে না পারে, তাহলে যেন তার অভিভাবক ন্যায়ের সাথে লেখার বিষয়বস্ত্ত বলে দেয়। আর তোমরা তোমাদের পুরুষদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী রাখ। অতঃপর যদি তারা উভয়ে পুরুষ না হয়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী- যাদেরকে তোমরা সাক্ষী হিসেবে পছন্দ কর।…” 102

রীতিনীতি ও অভ্যাসের ক্ষেত্রে:

1. মেহমানের প্রতি উত্তম আচরণ এবং অতিথিপরায়ণতা।

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:


“যে লোক আল্লাহ্ ও শেষ দিনে ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। আর যে লোক আল্লাহ ও শেষ দিনে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সম্মান করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহতে ও শেষ দিনে ঈমান রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, নতুবা চুপ থাকে। “103

2. পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ভালো সুগন্ধি ব্যবহার করা।

শাস্তির ক্ষেত্রে:

1. শাস্তি কার্যকর করার সময় মানবিক দিকগুলো বিবেচনায় রাখা।

যেমন, শাস্তি দেওয়ার সময় অমানবিক আচরণ থেকে বিরত থাকা।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:


“হে আয়িশাহ্! আল্লাহ তা’আলা নম্র ব্যবহারকারী। তিনি নম্রতা পছন্দ করেন। “104

মুকাম্মালাতের গুরুত্ব

মুকাম্মালাত শরিয়তের উদ্দেশ্যগুলোকে আরও সুসংহত এবং কার্যকর করে তোলে। এটি আগের স্তরগুলোকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য একটি পরিপূর্ণ কাঠামো প্রদান করে।

সূতরাং মুকাম্মালাত শরিয়তের উদ্দেশ্যের চূড়ান্ত স্তর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ইবাদত, লেনদেন, রীতিনীতি এবং শাস্তি সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আগের স্তরগুলোকে পূর্ণতা প্রদান করে।105

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, শরীয়ত এসেছে মানুষের কল্যাণেই। মানুষের উন্নত জীবন পরিচালনার জন্যই শরীয়ত।

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ভাগ করে করে আলোচনা করেছে শরীয়ত। একজন সন্ত্রাসীকে আপনি কিভাবে সঠিক পথে আনবেন। অর্থের লোভ দেখালে সে বলবে আমার কাছে টাকা পয়সার অভাব নেই। আইনের ভয় দেখালে সে বলবে আমি আইন পকেটে নিয়ে ঘুরি। যত শক্তিই প্রয়োগ করতে যাবেন তার সামনে তা টিকবে না। তখন তাকে বলার মতো একটি কথাই থাকবে আর তা হলো শরীয়তের কথা। একদিন তোমার মৃত্যু হবে। আল্লাহর সামনে তোমাকে দাঁড়াতে হবে। তোমার শক্তি সামর্থ্য তখন কিছুই থাকবে না। তখন তার কিছু বলার থাকবে না। তাকে ঠিক করার একমাত্র রাস্তাই হলো শরীয়ত। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা সমাধানের জন্য আছে শরীয়ত।

শরীয়ত। সুন্দরতম পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন। উন্নত জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন। আন্যায়, অত্যাচার আর জুলুম দূরীকরণে প্রয়োজন। মানব জীবনকে গতিশীল করতে প্রয়োজন। শরীয়ত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখার কথা বলে। শরীয়ত বলে কোন মানুষের লোকসান করা যাবে না। ইসলাম ও মুসলিম জাতির ক্ষতি করা যাবে না। যেখানে ইসলাম ও মুসলিম জাতির ক্ষতি হয় এখানে যাওয়া যাবে না। শরীয়ত বলছে তুমি এমন কাছ থেকে বিরত থাকো যেখানে অপর মুসলমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঈমান ও ঐতিহ্য নিয়ে বিব্রতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে। শরীয়তের এসব স্বার্থ মেনে চলাই মুমিনের কাম্য। মুমিন কখনো এসব এড়িয়ে চলতে পারে না। আল্লাহর সবাইকে খাঁটি মুমিন হওয়ার তৌফিক দান করুন।

উপসংহার:

শরীয়ত জীবনের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ দিশারী, যা মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার জন্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে দান করা হয়েছে। শরীয়ত মানুষের জন্য শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি সুষম ও সুন্দর জীবন ব্যবস্থা, যা তার দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার চাবিকাঠি। শরীয়তের বিধান অনুসরণ করলেই মানুষের প্রয়োজনীয়তা, উন্নতি ও শান্তি নিশ্চিত হয়। আমাদের সমাজের প্রতিটি সমস্যা ও অশান্তির সমাধান শুধু শরীয়তের আদর্শের মধ্যেই নিহিত। শরীয়ত সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে, অন্যায় দূরীকরণে ভূমিকা রাখে এবং মানবতার কল্যাণে নিরন্তর পথপ্রদর্শক। যখন আমরা শরীয়তের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি, তখনই আমরা একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ ও উন্নত সমাজ গঠনে সহায়তা করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে শরীয়তের সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং আমাদেরকে মাকাসিদুল শরিয়াহর প্রতিটি স্তর বুঝে এর বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। যাতে আমরা আমাদের জীবনকে কল্যাণময় ও সফল করে তুলতে পারি। আমিন।

আরো পড়ুন,

প্রসঙ্গ ব্যারিস্টার সুমনের লাইভ: শুরু করিতেছি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ তাআলার নামে

  1. (আল ওয়াজিয, পৃ. ২৯৯) ↩︎
  2. আল-মুয়াফাকাত: ২/৬২ ↩︎
  3. সূরা বাকারা ২ : ২১৬ ↩︎
  4. আল-মুয়াফাকাত (2/16) ↩︎
  5. আল- মাক্বাসিদুশ শারিয়াহ, নূরুদ্দীন আল-খাদেমী, পৃ. 85 ↩︎
  6. আত্‌ তা‘লীক আলাল মুআফাকাত ↩︎
  7. ইলমুল মাকাসিদিশ শারইয়্যাহ,নূরুদ্দিন আল-খাদিমি, পৃষ্ঠা ৭৯ ↩︎
  8. সুরা আল-ইমরান: ১৯ ↩︎
  9. সুরা আল-ইমরান: ৮৫ ↩︎
  10. সুরা আল-আনআম: ১২২ ↩︎
  11. সুরা মুহাম্মদ: ১২ ↩︎
  12. সুরা আল-ফুরকান: ৪৪ ↩︎
  13. নাজরিয়্যাতুল মাকাসিদ ইনদাল ইমাম আশ্-শাতিবী, আহমাদ রাইসুনী পৃ.156 ↩︎
  14. সূরা আল-ইমরান: ১০৪ ↩︎
  15. সূরা আল-ইমরান: ১১০ ↩︎
  16. সূরা আন- নাহল : ১২৫ ↩︎
  17. সূরা সাবা: ২৮ ↩︎
  18. সূরা ইউসুফ: ১০৮ ↩︎
  19. সূরা তওবা: ১২৩ ↩︎
  20. সূরা তওবা: ৩৬ ↩︎
  21. সূরা আনফাল: ৬০ ↩︎
  22. সহীহ মুসলিম হাদিস নং: ১৮৫২ ↩︎
  23. সুনানুন নাসায়ী, হাদীস নং: 4020 ↩︎
  24. সূরা মায়েদা: ৫৪ ↩︎
  25.  আল-ইমরান: ১৪০-১৪১ ↩︎
  26. আল-মুজাম আল-আওসাত, তাবরানী  – খণ্ড. ৪ পৃ. 184 হাদিস নং 3839 ↩︎
  27. সুনান আবূ দাউদ, কিতাবুল ইজারা (ভাড়া ও শ্রম বিক্রয়) হাদিস নং: 3462 ↩︎
  28. বাকারাহ: ২৫৬ ↩︎
  29. ইউনুস: ৯৯ ↩︎
  30. (তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানী) ↩︎
  31. কাহফ: ২৯ ↩︎
  32. সুরা: নিসা, আয়াত: ৮৪ ↩︎
  33. সুনানু আবি দাউদ হাদিস নং 4297 ↩︎
  34. সুনানু আবি দাউদ হাদিস নং 4297 ↩︎
  35. সূরা আল-আনকাবুত, আয়াত ৬৯ ↩︎
  36. (মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া খ.28 পৃ. 441) ↩︎
  37. প্রাগুক্ত) ↩︎
  38. সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ৪ ↩︎
  39. তাফসীরে কুরতুবী ↩︎
  40. আল-আনকাবুত ২৯:৬৯ ↩︎
  41. তাফসীরে বাগভী ↩︎
  42. সহীহ বুখারি, হাদিস নং : 335 ↩︎
  43.  সহীহ বুখারী, হাদীস নং: 2787 ↩︎
  44. সহীহ বুখারী, হাদীস নং: 2853 ↩︎
  45. সূরা সাফ: ১৩ ↩︎
  46. সুরা আল-হজ্ব: ৭৮ ↩︎
  47. জামেয়ে তিরমিজি , হাদিস নং: 1621 ↩︎
  48.  সুরা আল-ইসরা: ৩৩ ↩︎
  49. মাআত্তা মালেক, হাদিস নং 964 ↩︎
  50. মাআত্তা মালেক হাদিস নং: 963 ↩︎
  51. সুনানু আবি দাঊদ, হাদিস নং: 4300 ↩︎
  52. সূরা বাকারা: ২১৭ ↩︎
  53. علم المقاصد الشرعية، نور الدين الخادمي، ص81. ↩︎
  54. সূরা ইসরা: ৭০ ↩︎
  55. সূরা তীন: ৪ ↩︎
  56. সুরা মায়েদা, ৫:৩২ ↩︎
  57. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: 141 ↩︎
  58. কিতাবুল মুআফাকাত, ইমাম শাতেবী ↩︎
  59. সূরা নূর: ২৭ ↩︎
  60. সূরা নূর: ২ ↩︎
  61. সূরা নূর: ৪ ↩︎
  62. দেখুন, কিতাবু মাক্বাসিদিশ শারিয়াতিল ইসলামিয়্যাহ, ইবনে আশূর , 24 নং পৃষ্ঠা থেকে ↩︎
  63. সূরা আহযাব: ৭২ ↩︎
  64. সূরা মায়িদা: ৯০ ↩︎
  65. সূরা  আল-আম্বিয়া ,  আয়াত নং 24 ↩︎
  66. সূরা ফাতির: ২৮ ↩︎
  67. সূরা আয-যুমার  , আয়াত 18 ↩︎
  68. সূরা গাফির, আয়াত : 56 ↩︎
  69. সূরা বনি ইসরাইল: ৩৬ ↩︎
  70.  সূরা কাহ্ফ: 15 ↩︎
  71.  সূরাঃ আলে-ইমরান, আয়াত: 190 ↩︎
  72. সূরা নিসা,আয়াত: 82 ↩︎
  73. সূরা  মুলক, আয়াত: 15 ↩︎
  74. সূরা  মুলক, আয়াত: 15 ↩︎
  75. সূরা জুমুআ, ১০ ↩︎
  76. সহীহ বূখারী, হাদীস নং: 2072 ↩︎
  77. সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীস নং: 2443 ↩︎
  78. সহীহ বুখারি, হাদিস নং: 2227 ↩︎
  79. সূরা আল-বাকারা: ২৭৫ ↩︎
  80. সূরা আন-নিসা: ২৯ ↩︎
  81. সূরা আল-মায়িদা: ৩৮ ↩︎
  82. মুসলিম: ২৫৬৪ ↩︎
  83. সূরা হাদিদ: ৭ ↩︎
  84. সূরা আন-নূর: ৩৩ ↩︎
  85. সূরা আল-ইসরা: ১৬ ↩︎
  86. সূরা আন-নিসা: ৬ ↩︎
  87. সূরা আন-নিসা: ৫ ↩︎
  88. সূরা আন-নিসা: ২৯ ↩︎
  89. সূরা আত-তাওবা: ৩৪ ↩︎
  90. সূরা বাকারা ২:১৮৫ ↩︎
  91. সহীহ বুখারি, হাদিস: ৭২৮৮ ↩︎
  92. সূরা নিসা ৪:২৯ ↩︎
  93. সূরা মায়িদা ৫:৬ ↩︎
  94. সূরা হাজ্জ ২২:৭৮ ↩︎
  95. সূরা বাকারা ২:১৮৫ ↩︎
  96. সূরা আ’রাফ ৭:৩১ ↩︎
  97. সুনান আত তিরমিজী , হাদীস নং : 2627 ↩︎
  98. সূরাঃ আল-ফুরকান, আয়াত : 63 ↩︎
  99. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং: 54 ↩︎
  100. সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২০২০ ↩︎
  101. মাআত্তা মালেক, হাদিস নং 964 ↩︎
  102. সূরা বাকারা: ২৮২ ↩︎
  103. সহীহ বুখারি, হাদিস: ৬১৩৬ ↩︎
  104. সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৯৩ ↩︎
  105. আল ওয়াজিয, ডা. আব্দুল কারিম যায়দান, পৃ. ২৯৯-৩০২ (সারসংক্ষেপ)। ↩︎

1 thought on “শরিয়ত কি ও কেন? এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা”

  1. মাশাআল্লাহ, অনেক সুন্দর হয়েছে আল্লাহ তা’আলা আপনার এলেম ও আমলে বরকত দান করুক। আর সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করুক।
    আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top