মানব জীবনে সুন্নত : আবারো প্রয়োজন হুব্বে রাসুল

মানব জীবনে সুন্নত : আবারো প্রয়োজন হুব্বে রাসুল

হৃদয় কখন পাথরে পরিণত হয়? কখন মুখ থেকে অনুশোচনার একটি বাক্যও প্রকাশ পায় না? যখন মানুষ বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত থাকে। পাপ যত বাড়তে থাকে আত্মা তত কঠিন আকার ধারণ করতে থাকে। একটা সময় আসে, যখন কেউ তার নামটাও ভালোভাবে নিতে চায় না।সে মানুষটি যদি পায় কোন আলোকিত মানুষের পরশ। যদি থাকতে পারে কোন নিষ্ঠাবান আলেমের সান্নিধ্যে। তাহলে ধীরে ধীরে তিনিও হয়ে যান যুগের শ্রেষ্ঠ সাধক। শুধু জমিনে নয়, আসমানেও তিনি সম্মানিত হয়ে উঠেন। এক সময় যারা তাকে ঘৃণা করত তারাও তখন তাকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করে নেয়। এটা পরীক্ষিত। প্রমাণিত। ইতিহাস ঘাটলে এর নজির অভাব নেই।এত তমল পরিবর্তন!কিভাবে সম্ভব হলো! এক সময় ছিল কঠিন পাথর। আজ হয়ে গেলেন পরশ পাথর। এটা কিসের ফলাফল!! আবার দেখা গেছে কারো কারো জীবন পরিবর্তনের জন্য শুধু একটি দৃষ্টিই যথেষ্ট হয়েছে। তাতেই তিনি যুগশ্রেষ্ঠ মহামানবে পরিণত হয়েছেন। এবার প্রশ্ন জাগে। উলামাদের সাহচর্যে, হাতছানিতে ও নয়নদৃষ্টিতে এমন কি জাদু মাখা –যার ফলাফল এত সুন্দর! লম্বা জামা পরেন, মাথায় পাগড়ি বাধেন। এখানেই কি তাদের জাদু? নিশ্চয়ই না। তাদের জাদু রাসুলের সুন্নতে, নববী তরীকায়। সত্যিই সুন্নতের অনুসারী হয়ে দেখুন, জীবনে সফলতার সূর্যোদয় হবে। আপনার সাথীদের জীবনেও সে আলো ছড়াবে। নববী যুগের কথা, এক সাহাবী সম্পর্কে অনেকেই নালিশ করলেন। লোকটি নামাজ পড়ে আবার চুরিও করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন অচিরেই তার নামাজ তাকে সকল অন্যায় থেকে বিরত রাখবে। পরবর্তীতে এমনই হলো। তিনি সকল অন্যায় কাজ ছেড়ে দিলেন। নববী যুগটা এমনই ছিল। উজ্জ্বল। আলোকময়। কারণ সবাই সুন্নতের পরিপূর্ণ পাবন্দ ছিলেন। এর বিপরীতে যুগের নামাজ অধিকাংশের ক্ষেত্রে সারা জীবনে একবারের জন্যও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে না। কারণ নামাজে নেই নববী তরিকা। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও দাঙ্গা হাঙ্গামার মতো বড় বড় সংকট আজ আমাদের সমানে। এর মূল হিসেবে আপনি বলতে পারেন আন্তর্জাতিকভাবে আজ সুন্নত অবহেলিত । স্বদেশেও আজ শান্তি নেই, নিরাপত্তা নেই । কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে চলছে সুন্নতের অবজ্ঞা। বাজার মূল্যের ঊর্ধ্বগতি। মধ্যবিত্তদের টানাটানি। গরিবদের হাহাকার। কারণ, ব্যবসায়ী জীবনে সুন্নত পরিত্যাজ্য। ছেলে মদ খায়। মেয়ে ক্লাবে ড্যান্স করে। পরিবারে একটু শান্তি নেই। কারণ, পারিবারিকভাবে সুন্নত উপেক্ষিত। দেখতে মহা বিত্তবান। টাকা-পয়সার অভাব নেই। প্রকৃতপক্ষে মনে একটুও শান্তি নেই। দুশ্চিন্তা মাথা কুড়ে কুড়ে খায়। কারণ ব্যক্তি জীবনে সুন্নতের অবহেলা । স্বামী ইঞ্জিনিয়ার–সেলারি দুই লাখ। স্ত্রী ডাক্তার– ইনকাম নব্বই হাজার। কিন্তু মাসশেষে টানাটানি। ব্যাংকে কোটি টাকার লোন। কারণ,ব্যবহারিক জীবনে সুন্নতের অবজ্ঞা।এগুলো এ যুগের কমন চিত্র। শুধু এযুগে নয়, যে যুগেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, এর পেছনে দায়ী সুন্নতের প্রতি মানুষের অনীহা, অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। ইতিহাস জানায়,আব্বাসী খেলাফতের পতনের পিছনে দায়ী ছিলো তাদের শাসকরা। তারা বিলাসিতাপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। যা সুন্নতের পরিপন্থী।অপরদিকে বাদশা হারুনুর রশিদের রাজ্য এত শান্তিময় ছিল কেন? কারণ তারা সুন্নতের চর্চা করতো। সুন্নতকে ফলো করতো। অধুনা বিশ্বেও যদি সবক্ষেত্রে মানুষ সুন্নতকে প্রাধান্য দিতো। তাহলে বিশ্বযুদ্ধ নামক ভয়ঙ্কর শব্দ মানুষদের গা শিউরে তুলতো না। সামরিক শক্তিতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর অসহায় জনগণ ভয়-ভীতি আর বিপন্ন জীবনের সম্মুখীন হতো না। নিজের দেশে অন্তত স্বাধীনতার সাথে থাকতে পারতো।‌ রাষ্ট্রীয় জীবনে সজীবতা ফিরে আসতো। পারিবারিক জীবন সুখময় হয়ে উঠতো। ব্যক্তি জীবন আনন্দে দোলতো। ব্যবহারিক জীবনে সবকিছুতে বরকত পাওয়া যেতো। এগুলো সুন্নতের বাহ্যিক উপকারিতা।কিন্তু আফসোস! সুন্নতের মাঝে এত শক্তি থাকতেও আমরা তা উপলব্ধি করতে পারিনি। যদি এশক্তি দিল দিয়ে অনুভব করতে পারতাম তাহলে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না । এক্ষেত্রে এক সাধকের কথা মনে পড়ে। যিনি কোন এক ধর্মের উপর পঞ্চাশ বৎসর সাধনা করেছেন। তার সাধনা এতো গভীরে পৌঁছেছিলো যে, তিনি পাথরে তাকালে গলে পানি হয়ে যেত। এসব ছেড়ে তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন। এত বছরের সাধনা ত্যাগ করার কারণ সম্পর্কে লোকেরা জানতে চাইলে তিনি স্বীকারোক্তি দেন, পঞ্চাশ বছর মন্ত্রপাঠ ও আরাধনা করে আমি যে শক্তি অর্জন করেছি তার চেয়ে বেশী ক্ষমতা আমি একটি সুন্নতের মাঝেই দেখতে পেয়েছি। এটাই বাস্তবতা। ‘সুন্নতই শক্তি’ কথাটুকু যে বুঝতে পেরেছে, সে কখনো সুন্নত ছাড়তে পারে না। হাজার কষ্ট হলেও একেকটি সুন্নত পুঙ্খানুপুঙ্খ আদায় করবে । সুন্নতের প্রকৃত ক্ষমতা জানতে পারলে একজন বিধর্মীও সুন্নত ছাড়া থাকতে চাইবে না ‌। সবাইতো চায় দুনিয়ার সব বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে যাক। এক নবযুগের সূচনা হোক। যেখানে থাকবে না কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুন-খারাবি ও কোন অন্যায়-ব্যভিচার। যেখানে সবাই মিলেমিশে থাকবে। পুরো পৃথিবীতে এক অন্যরকম শান্তি বিরাজ করবে। শপথ শান্তি দাতার, নবাবী সুন্নত ছাড়া এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়। যারা সুন্নতকে অমূলক মনে করে। সবকিছুকে যুক্তি নিরিখে দেখতে চায়। তারা একটু ভাবুক। একটু মাথা খাটাক। জানতে পারবে সুন্নতের কতো ক্ষমতা। সুস্থ মস্তিষ্কে মাথা খাটালে তারাও বুঝতে পারবে মানব জীবন আলোকিত করার পিছনে সুন্নতের বিকল্প নেই। তবে খাঁটি মুমিনদের সুন্নত আদায়ের জন্য কোন যুক্তির দরকার হয় না। একটা তাদের ঈমানের দাবি। রাসূলের প্রতি মহব্বতের চাহিদা।

“একজন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার সবকিছু থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বেশি ভালো না বাসবে” – আল হাদিস।

একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পাওয়া তো এটাই। একজন খাঁটি মুমিনে পরিণত হবে। প্রিয় রাসূলের কাছে নিজেকে প্রিয় করে তোলবে। সব ক্ষেত্রে আল্লাহকে রাজি খুশি করবে। হাদিস বলছে তার জন্য নিজের থেকেও বেশি রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসতে হবে। যার দাবি সুন্নতে নববীকে আকড়ে ধরা। সুন্নত ছাড়া রাসুলের প্রতি ভালোবাসার গভীরতা আসবেনা। রাসুলের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া সুন্নতে মজা পাওয়া যাবে না। মহব্বতে মানুষ কত কিছুই না করতে করে থাকে, সুন্নতকে কি গ্রহণ করতে পারবে না। অবশ্যই পারবে৷ রাসুলের প্রতি বে–ইন্তিহা মোহাব্বত থাকতে হবে। কথায় আছে সত্যিকারের প্রেমে পড়লে মানুষের মনে এক ধরণের দিগ্বিজয়ী অনুভূতির জন্ম নেয়। যেনো সেই প্রেমটিকে ঘিরে সব কিছু করে ফেলা সম্ভব, সব বাঁধা পার করা সময়ের ব্যাপার।আমি দেখেছি প্রেমে পড়ে মানুষকে কাতরাতে। নিজে না খেয়ে, নিজে না পরে, প্রেমাস্পদকে খাওয়াতে, পরাতে। এতটুকু ভালোবাসাও যদি রাসূলের প্রতি আমাদের থাকতো তাহলে আমরা তার কোন সুন্নতকে হালকা ভাবে নিতাম না। যদিও রাসূলের প্রতি এতটুকু ভালবাসা তুচ্ছমাত্র। প্রয়োজন আরো বেশি আবেগের। ব্যাকুলতার । এত ভালোবাসার যার সামনে নিজের প্রাণটাও সামান্যমাত্র। হৃদয় যখন এতটা ব্যাকুল হবে তখন সুন্নতকে মধুর চেয়েও বেশি সুমিষ্ট মনে হবে। সবকিছু থেকে প্রিয়, সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন সুন্নতকেই লাগতে শুরু হবে। হৃদয়ে তখন এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হবে। মৃত্যুর পর যা মহাশান্তিতে পরিণত হবে।

1 thought on “মানব জীবনে সুন্নত : আবারো প্রয়োজন হুব্বে রাসুল”

  1. Pingback: মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভী রহ. এর আলোকিত জীবন, পর্ব—১ -

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top