মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ এবং ধর্মীয় নেতা। তিনি তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের মধ্যে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তাঁর জীবন ও কর্মের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের জীবন আলোকিত হয়েছে । এই নিবন্ধে, আমরা তাঁর আলোকিত জীবন ও অমূল্য অবদান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।এই লেখাটি মূলত সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর— “হযরত মাওলানা ইলিয়াস ওর উন কী দ্বীনি দাওয়াত” নামক কিতাব থেকে অনুবাদকৃত । মূল লেখাটি পড়তে অনুগ্রহ করে এই লিংকটি অনুসরণ করুন।
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি: জন্ম, শৈশব ও পারিবারিক পরিবেশ-
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহঃ)-এর জন্ম এবং শৈশবকাল তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। তাঁর ঐতিহাসিক নাম ছিল আখতার ইলিয়াস। তিনি এমন একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে ইসলামী পরিবেশ ছিল অত্যন্ত গভীর ও দৃঢ়।তাঁর শৈশব কেটেছে নানার বাড়ি কাঁন্ধলায় এবং তাঁর পিতার কাছে নিজামুদ্দিনে। সেই সময় কাঁন্ধলার এই পরিবারটি ছিল ধার্মিক চেতনার এক অনন্য কেন্দ্র। সেই পরিবারের শুধু পুরুষরাই নয়, বরং নারীরাও ধর্মীয় অনুশীলন, ইবাদত, রাতজাগা, জিকির এবং কুরআন তিলাওয়াতে এতটাই তৎপর ছিলেন, যা সেই সময়ের মানুষের কল্পনাতেও ছিল না।ঘরে সাধারণত মহিলারা নিজস্বভাবে নফল নামাজে কুরআন মজিদ তিলাওয়াত করতেন, এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পিছনে তারাবীহ ও অন্যান্য নফল নামাজে অংশগ্রহণ করতেন। রমজান মাসে কুরআন মাজিদ যেন এক আলোকোজ্জ্বল দীপ্তিতে ভরে উঠত। ঘরের প্রতিটি কোণে কুরআন মজিদের উজ্জ্বল পৃষ্ঠা আর তার তিলাওয়াতের সুমধুর সুরে এক অপার্থিব শান্তি বিস্তার লাভ করত, যা গভীর রাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকত।মহিলাদের মধ্যে এমন এক গহীন অনুভূতি ছিল, যেন তারা কুরআন তিলাওয়াত করার মাধ্যমে এক অমোঘ প্রশান্তি ও সৃজনশীল আনন্দ অনুভব করতেন। নামাজ শেষ হওয়ার পর, তারা একে অপরকে তাদের তিলাওয়াতের বিশেষ অংশ নিয়ে আলোচনা করতেন, যেন তাদের মধ্যে এক পবিত্র আলোচনা ও আলোকিত আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠত। নামাজের মধ্যে তাদের মনোযোগ এমন এক গভীরতায় ডুবে থাকত যে, ঘরের পর্দা টানানো, কিংবা বাইরের কোনো ঘটনা ঘটার ব্যাপারে একদমই কোনো সচেতনতা থাকত না।কুরআন মজিদ ও তার অনুবাদ, তাফসীর মাযাহির হক (تفسير مظاهر حق), মাশারিকুল আনওয়ার (مشارق الأنوار), হসন হাসিন (حصن حصين) — এই ছিল মহিলাদের আদর্শ পাঠ্যবই যা বাড়িতে প্রচলিত ছিল এবং প্রতিদিনের জীবনের একটি অমূল্য অংশ হয়ে উঠেছিল। সে সময় ঘরের ভিতর ও বাইরে বারবার আলোচনা হতো হজরত সাইয়েদ আহমদ শফি সাহেব (রহ.) এবং হজরত শাহ আবদুল আজিজ সাহেব (রহ.)-এর পরিবারের অতুলনীয় ঘটনা ও তাদের জীবনের স্মরণীয় কাহিনীগুলি। এসব মহান ব্যক্তিত্বদের কর্মকাণ্ড যেন গভীরভাবে বসে গিয়েছিল মানুষের স্মৃতিতে, এবং তা ছিল আলোচনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।মায়েরা এবং ঘরের মহিলারা শিশুদেরকে পাখি-মিনার গল্প শোনানোর পরিবর্তে এসব ঐতিহাসিক কাহিনী ও মহৎ ঘটনার গল্প শোনাতেন, যা একেবারে প্রাচীনও ছিল না। এগুলো ছিল মাওলানা মুজাফফর হোসেন সাহেবের নিজের চোখে দেখা ঘটনা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কানে শোনা জীবন্ত স্মৃতি। যারা এইসব শুনতেন, তাদের মনে হতো, যেন সেগুলো কোনো অতীতের গল্প নয়, বরং যেন গতকালের কথা।
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি— এর নানী
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহঃ)-এর নানী আমাতুর রাহমান । তিনি মাওলানা মুজফফর হোসেন (রহঃ)-এর সহধর্মিণী ছিলেন এবং পরিবারের মধ্যে সাধারণত “উম্মি বী” নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি রাবিয়া বসরী রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর মতো এক মহামানবী আধ্যাত্মিক নারীর অনুকরণীয় আদর্শে দীপ্তিত ছিলেন।তাঁর নামাজের ধরণ এতটাই বিশেষ ছিল যে, মাওলানা গঙ্গোহি (রহঃ)-এর নামাজের সাথে তুলনা করতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, “উম্মি বী-র নামাজের নমুনা আমি মাওলানা গঙ্গোহির নামাজে দেখেছি।” মাওলানা গঙ্গোহির নামাজও ছিল তাঁর যুগের মধ্যে এক অনন্য উদাহরণ।শেষ বয়সে উম্মি বী এমন একটি অবস্থায় ছিলেন যে, কখনও নিজের জন্য খাবার চাইতেন না। যদি কেউ খাবার এনে রাখতেন, তবে তা গ্রহণ করতেন। পরিবার বড় হওয়ায় নানা চাপ ও কাজের মধ্যে তাকে খাবার দেওয়ার কথা মনে না থাকলে তিনি না খেয়েই বসে থাকতেন। একবার কেউ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এত দুর্বল অবস্থায় কীভাবে অনাহারে থাকেন?” তিনি সাদরে উত্তর দিয়েছিলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আমি তাসবিহের মাধ্যমে আমার খাদ্য লাভ করি।”
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহঃ)-এর আম্মাজান-
হযরত ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর আম্মাজান ছিলেন একজন অত্যন্ত উচ্চমানের হাফেজা। বিবাহিত জীবনে তার প্রথম পুত্র মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেবের দুধ পানের সময় তিনি কুরআন মজিদ হিফজ করেছিলেন। তাঁর হিফজ ছিল এতই নিখুঁত যে, সাধারণ হাফিজদের তুলনায় তিনি অনেক এগিয়ে ছিলেন। রমজানে প্রতিদিন তিনি পুরো কুরআন মজিদ এবং অতিরিক্ত দশ পারা তিলাওয়াত করতেন। এইভাবে, প্রতি রমজান মাসে তিনি চল্লিশবার কুরআন মজিদ খতম করতেন। এত ব্যাপক তিলাওয়াতের পরেও তাঁর ঘরের কাজকর্মে কোনও ব্যাঘাত ঘটত না; বরং তিলাওয়াতের সময় তার হাত দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে অন্য কাজও চলতে থাকত।রমজান ছাড়া, তাঁর দৈনন্দিন জীবনে নিয়মিত যে আমলগুলো করতেন, সেগুলি ছিল:
- دُرُود شریف (Durud Sharif) – পাঁচ হাজার বার
- بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (Bismillahir Rahmanir Rahim) – এক হাজার নয়শো বার
- يَا مَنِيُّ (Ya Maniyyu) – এক হাজার একশো বার
- لَا إِلٰهَ إِلَّا اللَّهُ (La Ilaha Illallah) – পাঁচশো বার
- اللَّهُ أَكْبَرُ (Allahu Akbar) – দুইশো বার
- سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ (Subhanallahi wa bihamdi) – দুইশো বার
- أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ (Astaghfirullaha) – পাঁচশো বার
- فَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ (Fawwadtu Amri Ila Allah) – তিনশো বার
- حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (Hasbunallahu wa ni’mal wakeel) – পাঁচশো বার
- رَبَّي اني مغلوب فانتصر (Rabbana Maghlubun Wa Nu) – তিনশো বার
- رَبَّي اني مسني الضر وأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّحِمِينَ (Rabbana Anta Arhamur Rahimeen) – দুইশো বার
- لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ (La Ilaha Illa Anta Subhanaka Inni Kuntu Minaz Zalimeen) – তিনশো বার
এছাড়া, প্রতিদিন এক মনজিল কুরআন তিলাওয়াত তাঁর অভ্যাস ছিল তার।
প্রাথমিক শিক্ষা-
অন্যান্য শিশুর মতো তারও কুরআন ও মকতব শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় । পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী, শৈশবকালেই তার অন্তরে কুরআন মুখস্ত করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয় এবং শৈশবকালেই তিনি হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করেন। এ পরিবারে হিফজুল কুরআনের প্রতি এতটাই গুরুত্ব ছিল যে, পারিবারিক মসজিদের দেড় কাতারে মুয়াজ্জিন ছাড়া অন্য কোনো গায়রে হাফেজ দাঁড়াতো না।
বড়দের সুধারণা ও নেক দৃষ্টি-
মাওলানা (রহঃ)-এর প্রতি “উম্মি বী” এর (মাওলানা সাহেবের নানী) গভীর মমতা ও স্নেহ ছিল । তিনি প্রায়ই বলতেন, “আখতার, তোমার মধ্যে আমি সাহাবিদের সুবাস অনুভব করি।” কখনও পিঠে মমতার সঙ্গে হাত রেখে বলতেন, “কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে তোমার মধ্যে, যে তোমার সঙ্গে আমি যেন সাহাবিদের মতো চরিত্রগুলোকে চলতে-ফিরতে দেখি।” মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহঃ)-এর মধ্যে শুরুর থেকেই ছিল সাহাবিদের প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং তাদের মতো দীনি জজবা ও ব্যাকুলতার এক ঝলক। এটি দেখে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান (রহঃ)—বলতেন,
“যখন আমি মাওলানা ইলিয়াসকে দেখি, তখন আমার চোখে সাহাবিদের চিত্র ভেসে ওঠে।”
শৈশবকালে দাওয়াতের প্রতি হযরতের স্পৃহা-
ইসলামের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা, যা পরবর্তী সময়ে এক সুশৃঙ্খল ও সংহত রূপে বিকশিত হয়েছিল, তা তাঁর চরিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। যে ধর্মীয় পরিবেশে তিনি শৈশব কাটিয়েছেন এবং যা বয়োজ্যেষ্ঠদের উপদেশ ও ঐতিহ্যের মাধ্যমে তাকে গড়ে তুলেছিল, তা তাঁর অন্তরে এমন এক প্রজ্জ্বলিত আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, যা শৈশবেই তার মধ্যে প্রকট হয়েছিল। তার মকতব সহপাঠী রিয়াজুল ইসলাম কান্ধলভী একদিন স্মরণ করে বলেছিলেন, “যখন আমরা মকতবে পড়তাম, তখন একদিন তিনি কাঠের একটি টুকরো হাতে নিয়ে এসে বললেন, ‘
চলো, মিয়া রিয়াজুল ইসলাম, আজ থেকে আমরা বেনামাজী লোকদের বিরুদ্ধে জিহাদে নামি!
গঙ্গোহে গমন ও আধ্যাত্মিকতা লাভ-
শাওয়াল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব ও মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেবের মধ্যম ভাই হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ সাহেব গঙ্গোহী রহমাহুল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়ার জন্য গঙ্গোহে চলে যান এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব তাঁর পিতার সান্নিধ্যে দিল্লির নিজামুদ্দিনে ছিলেন। তবে পিতার স্নেহ এবং নিজেকে গভীরভাবে ইবাদত-বন্দেগিতে ব্যস্ত রাখার কারণে শিক্ষার প্রতি তাঁর মনোযোগে ভাটা পড়েছিল । একদিন মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া সাহেব, যিনি পিতার কাছে পরামর্শদাতা ছিলেন, পিতার কাছে বললেন, “ভাইয়ের শিক্ষা সঠিকভাবে হচ্ছে না, আমি তাঁকে গঙ্গোহে নিয়ে যাব।” পিতা এই প্রস্তাবে সম্মতি জানান, এবং মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে গঙ্গোহে যাত্রা করেন।গঙ্গোহ তখন ছিল ইসলামী জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেখানে, মাওলানা রশিদ আহমদ সাহেব গঙ্গোহী রহমাহুল্লাহর সান্নিধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব রাতদিন যে ধর্মীয় আলোচনা, জ্ঞান এবং ইবাদতের পরিবেশ লাভ করেছিলেন, তা তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এই সান্নিধ্য তাকে ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইসলামি জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীর ভালবাসা ও অনুভূতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।গঙ্গোহে অবস্থান করার সময়, মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব মাত্র দশ-এগারো বছর বয়সী ছিলেন এবং এখানে তাঁর দশ বছর ছিল একটি ঐতিহাসিক অধ্যায়। এই সময়ে, তিনি মাওলানা রশিদ আহমদ সাহেব গঙ্গোহী রহমাহুল্লাহর সান্নিধ্যে ধর্মীয় জীবন এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে গভীর শিক্ষা লাভ করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর জীবনের মূল চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে।১৩৩৩ হিজরী সালে মাওলানা রশিদ আহমদ সাহেব গঙ্গোহী রহমাহুল্লাহর ইন্তেকালের পর, মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব তখন বিশ বছর বয়সী যুবক ছিলেন। গঙ্গোহে তাঁর দশ বছরব্যাপী সময়কাল ছিল এক অনুপ্রেরণামূলক অধ্যায়, যা তাঁর জীবন এবং ইসলামী আন্দোলনে এক নতুন দিশা এবং শক্তি যোগ করে।মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব ছিলেন এক অতুলনীয় শিক্ষক ও মুরব্বি। তিনি সর্বদা নিশ্চিত করতেন যে, সম্ভাবনাময় ছোট ভাইটি তাঁর সোহবত ও মজলিসের আধ্যাত্মিক বরকত থেকে পুরোপুরি উপকৃত হোক। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ) প্রায়ই বলতেন, “যখন হযরত গঙ্গোহীর বিশেষভাবে গড়ে তোলা আলেমগণ, যাঁরা তাঁর জ্ঞান ও প্রভাব দ্বারা সমৃদ্ধ, আমাদের কাছে আসতেন, তখন অনেক সময় আমার পাঠ বন্ধ করে দেওয়া হতো। আমাকে বলা হতো,
‘এখন তোমার পাঠ হলো, তাঁদের সোহবতে বসা এবং তাঁদের আলোচনা শোনা।'”
গাঙ্গহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হাতে বাইয়াত-
হযরত গঙ্গোহী (রহিমাহুল্লাহ) সাধারণত শিশু বা শিক্ষার্থীদের বায়াত গ্রহণ করতেন না। সাধারণত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরই এমন অনুমতি দেওয়া হতো। তবে মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ)-এর বিশেষ অবস্থার কারণে এবং তাঁর আগ্রহ ও অনুরোধের ভিত্তিতে তাঁকে বায়াত গ্রহণ করানো হয়েছিল।মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ)-এর স্বভাবে ছোটবেলা থেকেই অন্তরের গভীরে ভালোবাসার এক স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত ছিল। তাঁর প্রতি হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী (রহিমাহুল্লাহ)-এর এমন এক অন্তরের টান সৃষ্টি হয়েছিল যে, তাঁর সংস্পর্শ ছাড়া শান্তি অনুভূত হতো না। তিনি বলতেন, “কখনো কখনো রাতে শুধুমাত্র হযরতের চেহারা দেখার জন্য উঠে যেতাম। তাঁর জিয়ারত করেই শান্তি অনুভব করতাম এবং তখনই ঘুমাতে পারতাম।”হযরত গঙ্গোহী (রহিমাহুল্লাহ)-ও মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ)-এর প্রতি গভীর স্নেহ প্রদর্শন করতেন। তিনি একবার বলেছিলেন, “একদিন ইলিয়াস আমার কাছে এসে বলল, ‘যদি হযরত অনুমতি দেন, তবে আমি আপনার পাশে বসে পড়াশোনা করতে চাই।’ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহই সাহেব হযরতের কাছে এ অনুরোধ পেশ করলে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। ইলিয়াস আমার একান্ত সময়ে কোনো ব্যাঘাত ঘটাবে না এবং আমার মনের স্থিরতায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।'”এই বিশেষ সম্পর্কের নিদর্শন মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ)-এর জীবনে এক গভীর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল।মাওলানা (রহিমাহুল্লাহ) বলতেন, “যখন আমি জিকির করতাম, তখন অন্তরে যেন একটি ভার অনুভূত হতো। আমি এ বিষয়টি হযরতের কাছে ব্যক্ত করলে তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম (রহিমাহুল্লাহ) একসময় হাজী সাহেব (রহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে একই অনুভূতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। তখন হাজী সাহেব বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই আপনার মাধ্যমে কোনো মহান কাজ করাবেন।’”
মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহিমাহুল্লাহ)-এর শিক্ষাদানের অনন্য ধারা-
মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহিমাহুল্লাহ) শিক্ষাদানে এক বিশেষ ও গবেষণাধর্মী পদ্ধতির প্রবর্তক ছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষায় তিনি প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকের উপর নির্ভর না করে নিজেই নীতিমালা ও ব্যাকরণবিষয়ক নিয়মাবলী লিখিয়ে দিতেন। ছোট ছোট শব্দের উদাহরণ দিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের বলতেন, “এসব শব্দের রূপান্তর ও বিশ্লেষণ তৈরি কর।” এভাবে তিনি শিক্ষার্থীদের চিন্তা ও গবেষণার ক্ষমতা জাগ্রত করতেন। ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি শুরু থেকেই গভীর গুরুত্বারোপ করতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহিমাহুল্লাহ)-এর ‘চেহল হাদিস’ এবং “আম্মা পারা” এর পাঠদান করাতেন। তিনি বলতেন, “মুসলিম শিশুদের সাধারণত “আম্মা পারা” মুখস্থ থাকে। এতে নতুন করে শব্দ মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই; কেবল অর্থ শিখলেই যথেষ্ট।” তিনি আরও বলতেন, “কুরআন ও হাদিসের শব্দসমূহে বিশেষ বরকত রয়েছে। এগুলো শেখা শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”মাওলানা ইয়াহইয়া (রহিমাহুল্লাহ)-এর শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা ও আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা। তিনি পাঠ্যপুস্তকের সমাপ্তি নিয়ে কঠোর ছিলেন না। বরং তিনি শিক্ষার্থীদের হাশিয়া ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ পড়ার দায়িত্ব দিতেন এবং নিজে সহায়তা না করে তাদের স্বাধীনভাবে অধ্যয়নে অভ্যস্ত করতেন। যখন তিনি নিশ্চিত হতেন যে, শিক্ষার্থী নিজ প্রচেষ্টায় ও কোনো শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই বইয়ের কয়েকটি পৃষ্ঠা গভীরভাবে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে, তখনই তিনি তাদের নতুন কোনো বইয়ের পাঠ শুরু করাতেন।আরবী ভাষার দৃঢ়তা এবং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনের দিকে তাঁর ছিল বিশেষ মনোযোগ। মাওলানার শিক্ষার ফলে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে এমন এক দক্ষতা গড়ে উঠত যা তাদের গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণায় অদ্বিতীয় করে তুলতো । তাঁর শিক্ষা তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও গভীর জ্ঞানের শিকড় স্থাপন করত।
শিক্ষার বিরতি এবং পুনরায় সূচনা-
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি শিশু বয়স থেকেই দুর্বল এবং শীর্ণ দেহী ছিলেন। গঙ্গোহে অবস্থানকালে তার স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এক বিশেষ ধরনের মাথাব্যথায় তিনি আক্রান্ত হন, যার কারণে মাসের পর মাস মাথা সোজা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এমনকি বালিশে সিজদা করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। মাওলানা নূরী রাহিমাহুল্লাহর পুত্র হাকিম মাসুদ আহমদ সাহেব তার চিকিৎসক ছিলেন। তার বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল এই যে কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে পানি পুরোপুরি পরিহার করার নিয়ম ছিল । খুব কম মানুষই এই কঠিন নিয়ম সহ্য করতে পারতেন, কিন্তু মাওলানা তার শক্ত ইচ্ছাশক্তি এবং দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে এই নিয়ম অনুসরণ করেন। তিনি সাত বছর ধরে এক ফোটাও পানি পান না করে পুরোপুরি পানি সংযম করেছেন এবং আরও পাঁচ বছর ধরে খুবই অল্প পরিমাণ পানি পান করতেন।এই গুরুতর অসুস্থতা এবং বিশেষত মস্তিষ্কের দুর্বলতার কারণে তার শিক্ষা কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর পুনরায় চালু করার কোনো আশা ছিল না। তবে মাওলানা এই অসমাপ্ত শিক্ষা নিয়ে গভীরভাবে দুঃখিত ছিলেন এবং পুনরায় তা শুরু করার জন্য তার অন্তরে একটি আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যদিও তার গুরুজন তাকে বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছিল। একদিন তার ভাই তাকে বলেছিলেন, “এই অবস্থায় পড়াশোনা করে করবেটা কি ?” মাওলানা উত্তর দিয়েছিলেন, “ বেঁচে থেকেই করবোটা কি ? বরং পড়াশোনা করেই তো কিছু করা সম্ভব!” তার এই অটল ইচ্ছাশক্তি ও আকাঙ্ক্ষার কারণে তাকে আবার পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয় এবং তার শিক্ষা পুনরায় শুরু হয়।
মাওলানা গঙ্গোহী রহ. এর ইন্তেকাল-
১৩৩৩ হিজরিতে হজরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি আলাইহি ইন্তেকাল করেন। মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সাহেব তার বাম পাশে বসা ছিলেন এবং সূরা ইয়াসিন পাঠ করছিলেন।এই শোকাবহ ঘটনার মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর হৃদয়ে যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, তা তার নিজের কথায় উঠে আসে, তিনি বলতেন: “আমার জীবনে দুটি শোকই সবচেয়ে গভীর ছিল—একটি আমার পিতার ইন্তেকাল এবং অন্যটি হজরত মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেবের ইন্তেকাল।
” তিনি আরো বলতেন, “হজরত! আমরা তো সারা জীবনের কান্না একদিনে শেষ করে ফেলেছিলাম, যেদিন হজরত এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।”
হাদীসের শাস্ত্রে পূর্ণতা লাভ-
১৩২৭ হিজরিতে তিনি শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেব রহিমাহুল্লাহর দরস-হালকায় অংশগ্রহণের জন্য দেওবন্দে যান এবং সেখানে তিরমিজি ও বুখারি শরিফ শ্রবণ করেন।দেওবন্দের দরসে অংশগ্রহণের অনেক বছর পর মাত্র চার মাসের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তিনি তার ভাই মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেবের কাছে আবার হাদীসের দোরা করেন।
পুনর্বায়াত ও তাসাউফের পূর্ণতা লাভ-
হজরত মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেবের ইন্তেকালের পর, তিনি শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেবের কাছে আবেদন করেন এবং তিনি তাকে মাওলানা খালিল আহমদ সাহেবের কাছে রুজু হওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর তিনি মাওলানা সাহারনপুরী থেকে তার সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং তার তত্ত্বাবধানে সুলূকের মাকামগুলো অতিক্রম করেন।
ইবাদতের প্রতি একনিষ্ঠতা-
গঙ্গোতে অবস্থানকালে, হজরত মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি’র ইন্তেকালের পর, তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত নিরবতা এবং গভীর মননশীলতার অবস্থা বিরাজ করত। সম্ভবত সারা দিনে একদমই কম কথা বলতেন। শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকরিয়া সাহেব বলেন, “আমরা তখন তাঁর কাছে প্রাথমিক ফার্সি পাঠ করতাম। সে সময়, তিনি তাঁর সাধনা ও ভাবনায় এতই মগ্ন থাকতেন যে, হজরত শাহ আবদুল কুদ্দুস রহমতুল্লাহি আলাইহি’র মাক্ববারার পেছনে চাটাই বিছিয়ে দুজন হয়ে একদম নিঃশব্দে দুই পা মুড়ে বসে থাকতেন। আমরা যেতাম এবং বইটি তাঁর সামনে রেখে, আঙুল দিয়ে পড়ার জায়গা দেখিয়ে পাঠ শুরু করতাম। তিনি ফার্সি কবিতা পড়তেন এবং তার অনুবাদ করতেন। যেখানে আমরা ভুল পড়তাম, তিনি আঙুলের ইশারায় বইটি বন্ধ করে দিয়ে পাঠ শেষ করে দিতেন। এর মানে ছিল, ‘পুনরায় অধ্যয়ন করে নিয়ে আসো।
’”সেই সময়, নফল ইবাদতের প্রতি তাঁর এক গভীর অনুরাগ ছিল। মাগরিবের পর এবং ইশার নামাজের কিছু পূর্ব মুহূর্তে, তিনি নফল ইবাদতে নিঃশব্দে মগ্ন থাকতেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
বড়দের প্রতি প্রেম আকর্ষণের অন্যান্য উদাহরণ-
তাঁর হৃদয়ে এক অদম্য তৃষ্ণা এবং একাগ্রতা ছিল, যা ছাড়া আধ্যাত্মিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই একাগ্রতা ও আত্মবিস্মরণের ফলে, তাঁর শারীরিক দুর্বলতা এবং অবস্থা সত্ত্বেও তিনি এক বিরল এবং বিস্ময়কর কাজ সম্পন্ন করেছিলেন, যা তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির সাথে কোনোভাবেই খাপ খেত না।একবার, তাঁর শেষ অসুস্থতার সময়ে, তিনি এক স্মরণীয় ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন: “একবার আমি এতটাই অসুস্থ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম যে, উপরের তলা থেকে নিচে নামা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। এমন সময় খবর পেলাম, হজরত সাহারনপুরী দিল্লিতে এসেছেন, আর আমি তখনই অসহ্য দুর্বলতার মাঝেও, পা দিয়ে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। আমি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমি এত অসুস্থ ছিলাম যে, উপরের তলা থেকে নামা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। দিল্লির পথে চলতে চলতে, এই বিষয়টি আমার মনে পড়ল।”
অন্যান্য বুজুর্গ ও মাশায়েখদের সান্নিধ্য লাভ-
গঙ্গোহে অবস্থানকালে, হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ সাহেবের ইন্তিকালের পর, অন্যান্য শাইখগণ এবং মাওলানা গঙ্গোহীর বড়-ছোট সাথীদের সঙ্গে সম্পর্ক ও সান্নিধ্য অব্যাহত ছিল। শাহ আবদুর রহীম সাহেব রায়পুরী, মাওলানা মাহমুদ হাসান দিওবান্দী এবং মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি- এর সঙ্গে তার সম্পর্ক এমন ছিল যে, তিনি বলতেন, “এই ব্যক্তিরা আমার দেহ ও মন থেকে রয়েছেন, এবং তারাও মাওলানা গঙ্গোহীর বিশেষ গুণাবলীর কারণে আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও সম্মান প্রদান করতেন।”
আধ্যাত্মিকতা ও জিহাদী জযবা-
নফল ইবাদত ও জিকির-আজকারের পাশাপাশি, শুরু থেকেই মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর হৃদয়ে জেহাদি জজবা গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। যারা তাঁর জীবনের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে জানতেন, তারা সাক্ষ্য দিতেন যে এই জজবা ও সংকল্প তাঁর জীবনের কোনো পর্যায়েই ম্লান হয়নি। এ কারণেই তিনি মাওলানা মাহমুদ হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর হাতে “বাইয়াতে জিহাদ” গ্রহণ করেছিলেন।
বড়দের চোখে মাওলানার ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মর্যাদা-
শুরু থেকেই পরিবারের বুজুর্গ ব্যক্তিগণ এবং সমসাময়িক অন্যান্য শাইখরা মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-কে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখতেন। তাঁর বয়স তখন অল্প হলেও, অভিজ্ঞ ও প্রবীণ ব্যক্তিরা তাঁর প্রতি গভীর সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন।
মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া সাহেব, যিনি তার পিতার স্থানে ছিলেন তবুও তিনি তার সাথে এমন আচরণ করতেন, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে হযরত উসমান رضي الله عنه-এর সম্পর্কের অনুরূপ ছিল।
শারীরিক দুর্বলতা ও মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর নিবেদিত জীবন-
শারীরিক দুর্বলতার কারণে মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি কখনোই শারীরিক পরিশ্রমের কাজে অংশ নিতে পারেননি। তবে তিনি তার সময়ের সিংহভাগ ব্যয় করতেন অধ্যয়ন, জিকির-আজকার এবং ইবাদতে। বিপরীতে, তার ভাই মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেব ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ ও পরিশ্রমী। তার একটি বাণিজ্যিক গ্রন্থাগার ছিল, যার সমস্ত কাজ তিনি গভীর আগ্রহ ও একাগ্রতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। এই গ্রন্থাগার তাদের পরিবারের জন্য আয়ের প্রধান উৎস ছিল।একদিন গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপক, যিনি মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেবের বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন, সহানুভূতির সুরে বললেন, “মাওলানা ইলিয়াস সাহেব গ্রন্থাগারের কাজে অংশ নেন না। তাঁকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া উচিত, এতে তাঁরও উপকার হবে।”এই কথা শুনে মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললেন,
“হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা যে রিযিক বা সাহায্য লাভ করো, তা তোমাদের দুর্বলদের কারণে আসে।’
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই রুগ্ন ও দুর্বল ছেলেটির কারণেই আমরা রিযিক অর্জন করছি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আর কিছু বলবেন না। যদি কিছু বলার থাকে, তবে সরাসরি আমাকে বলুন।”এই জবাব তার মমতা ও দূরদৃষ্টির অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ।
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর ইমামতির এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত-
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর আধ্যাত্মিক পবিত্রতা এবং বিশেষ মর্যাদা বড়দের কাছে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই মর্যাদা ও আস্থার কারণে, কখনো কখনো তাঁকে বড়দের উপস্থিতিতেও ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে বলা হতো।একবার কাঁন্ধলায় একটি ঐতিহাসিক পরিবেশে এই ঘটনা ঘটে। তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণ—শাহ আবদুর রহীম রায়পুরী, মাওলানা খালিল আহমদ সাহারনপুরী এবং মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহমাতুল্লাহি আলাইহিম। নামাজের সময়, মাওলানা ইলিয়াসকে সম্মানের সঙ্গে ইমামতির জন্য সামনে আনা হয়।তখন পরিবারের একজন প্রবীণ সদস্য, মাওলানা বদরুল হাসান সাহেব, হাসিমুখে মজা করে বললেন, “এত বড় বড় গাড়ি, আর চালানোর জন্য এত হালকা ইঞ্জিন!” তাঁর রসিকতার জবাবে একজন বিজ্ঞ সদস্য মন্তব্য করেন, “ইঞ্জিনের শক্তিই তো আসল। কাজটা ইঞ্জিনের ক্ষমতার ওপরই নির্ভর করে।”এ সব ঘটনা শুধু মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রতি বড়দের অগাধ আস্থারই প্রমাণ নয়, বরং তাঁর মেধা ও আধ্যাত্মিক শক্তির এক অনন্য স্বীকৃতি।
মাজাহিরুল উলূমে মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-এর শিক্ষকতার সূচনা-
শাওয়াল মাসে সাহারানপুর থেকে মাজাহিরুল উলূমের একটি বিশাল কাফেলা হজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই কাফেলা মাদরাসার অধিকাংশ বরেণ্য শিক্ষক ও শায়খদের নিয়ে গঠিত ছিল। তাদের অনুপস্থিতিতে মাদরাসার পাঠক্রম সচল রাখার জন্য নতুন কিছু শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়া হয়।সেই সময়, মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি-কে একজন নবীন শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁকে মাদরাসার মধ্যম স্তরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কাফেলার যাত্রা শেষে, অন্যান্য নতুন শিক্ষকরা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেও, মাওলানা তাঁর শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন।এ সময়ে তিনি এমন অনেক কিতাবের পাঠদান দিয়েছেন যা আগে তার পড়া সম্ভব হয়নি। এই কিতাবগুলো তার জন্য নতুন ছিল, কারণ তার বড় ভাই ওস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া (রহিমাহুল্লাহ) এর পাঠদানে কিতাব সম্পূর্ণভাবে শেষ করার কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। পাশাপাশি, তিনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন তাই কিছু বই পড়তে পারেনি। তবে শিক্ষকতায় আসার পর তিনি এই অনধিত কিতাবগুলো দক্ষতার সাথে পাঠদান করেছেন। তিনি প্রস্তুতি স্বরূপ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো গুরুত্বের সাথে মোতালাআ (অধ্যয়ন) করতেন।যেমন, কানযুদ্দাকায়িক (كنز الدقائق) এর জন্য বাহরুর রায়েক (البحر الرائق), আশ-শামি (الشامي) এবং আল-হিদায়া (الهداية) কিতাব গুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করতেন। এছাড়া, নূরুল আনওয়ার (نور الأنوار) এর জন্য হুসামি (حسامي) এবং তার ব্যাখ্যাগুলোও খুঁটিয়ে দেখতেন এমনকি, আত-তালওবীহ (التلويح) পর্যন্ত দেখতেন।
নিকাহ-
১৩৩৩ হিজরী সালের জিলকাদ মাসের ১৩ তারিখ (১২ই মার্চ) শুক্রবার, নামাজ-এ-আসর পর তার মামা মাওলানা রউফুল হাসান সাহেবের কন্যার সাথে তার নিকাহ সম্পন্ন হয়। নিকাহ শরিয়তীভাবে পড়ান মাওলানা মোহাম্মদ সাহেব। এই ঐতিহাসিক নিকাহ সম্মেলনে মাওলানা খালিল আহমদ (সাহারানপুরী), শাহ আবদুর রহীম (রায়পুরি) এবং মাওলানা আশরফ আলী (থানভী) রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মাওলানা থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর প্রখ্যাত গ্রন্থ “ফাওয়াইদুস-সুহ্বত” যা বারবার প্রকাশিত হয়েছে, সেই বইটি কাঁন্ধলাহ মসজিদে, এই নিকাহ অনুষ্ঠানের উপলক্ষেই প্রথম প্রকাশ হয়।
প্রথম হজ-
১৩৩৩ হিজরীতে, মাওলানা খালিল আহমদ সাহেব ও মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেব হজ পালনের উদ্দেশ্যে সফরের পরিকল্পনা করেছিলেন। যখন মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ) এই খবর শুনলেন, তার মধ্যে এক অপ্রতিরোধ্য আকুলতা সৃষ্টি হলো। তিনি বলেছিলেন, “আমি অনুভব করছিলাম, তাদের পর ভারত আমার কাছে অন্ধকার হয়ে যাবে এবং এখানকার জীবন কঠিন হয়ে উঠবে।”তার আপন বোন, যিনি মাওলানা ইকরামুল হাসান সাহেবের মা, তার অস্থিরতা দেখে তাকে বললেন, “আমার অলংকারগুলো নিয়ে রওনা হয়ে যাও।” কিন্তু তার পরবর্তী ধাপ ছিল অনুমতি নেওয়া। প্রথমে, তিনি মা’র অনুমতির বিষয়ে চিন্তা করেছিলেন, যেহেতু তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে মা হয়তো এত দীর্ঘ এবং দূরের সফরের অনুমতি দেবেন না। তবে আল্লাহর কৃপায়, মা সহজেই অনুমতি প্রদান করেন।এরপর দ্বিতীয় ধাপ ছিল তার ভাই, মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহইয়া সাহেবের অনুমতি নেওয়া। মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ) ধারণা করেছিলেন যে, তিনি হয়তো অনুমতি দেবেন না, কিন্তু মা’র অনুমতির পর যখন ভাইয়ের কাছেও অনুমতি পাওয়া গেল, তখন তিনি শান্ত হলেন।তৃতীয় এবং শেষ ধাপ ছিল মাওলানা খালিল আহমদ সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণ। মাওলানা ইলিয়াস (রহিমাহুল্লাহ) তাকে একটি চিঠি লিখলেন, যেখানে সফরের সকল প্রস্তুতির বিস্তারিত বর্ণনা দেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, প্রথমত তার বোনের অলংকার নিতে যাওয়ার কথা, দ্বিতীয়ত কিছু ঋণের বিষয় এবং তৃতীয়ত কিছু আত্মীয়দের টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা। মাওলানা খালিল আহমদ সাহেব সফরের অনুমতি প্রদান করেন এবং সফরের জন্য শেষ পন্থাটি অগ্রাধিকার দেন।মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেব প্রথম জাহাজে রওনা হন, আর মাওলানা খালিল আহমদ সাহেব দ্বিতীয় জাহাজে সফর শুরু করেন। শাওয়াল মাসের ১৩৩৩ হিজরীতে তারা মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং রাবি’উল-আখির ১৩৩৩ হিজরীতে ফিরে এসে মাদরাসার পাঠদান কর্মে পুনরায় যুক্ত হন।
ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ, মুরব্বি ও বড় ভাই মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহইয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি- এর ইন্তেকাল-
হজের পরবর্তী বছর, জিলকাদ মাসে, মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া সাহেব ইন্তেকাল করেন। এই দুঃখজনক ঘটনা মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের জন্য এক অপার কঠিন পরীক্ষা ছিল, কারণ তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, বরং মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের পরম শুভাকাঙ্ক্ষী, আদর্শ সঙ্গী এবং সহানুভূতিশীল ভাই ছিলেন। মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার অপ্রতিরোধ্য গুণাবলী এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে পুরো সিলসিলায় তাঁর প্রস্থান একটি গভীর শোকের সৃষ্টি করেছিল। তবে, মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের অন্তরে এই শোকের অভিঘাত ছিল অত্যন্ত তীব্র, যা তাঁর মনের গভীরে আজীবন বিরাজ করেছিল।মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের একটি অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি প্রয়াত ভাইয়ের কথা স্মরণ করতেন, তখন এক অদ্ভুত মুগ্ধতা ও আবেগের ছোঁয়া তাঁর মনকে অস্থির করে ফেলত। এ সময় তিনি সব কিছু ভুলে যেতেন এবং গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের গুণাবলী, দক্ষতা এবং জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কথা স্মরণ করতেন। তিনি বলতেন, “হজরত, আমার ভাই এমন ছিলেন।” বিশেষভাবে, মাওলানা মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার মধুর সংযম, পরিমিতি, বিপরীত মতামত ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি একত্রিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা, তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা এবং নিখুঁত যুক্তির প্রতি মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের শ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন।মাওলানা ইলিয়াস সাহেব গভীর আগ্রহে তাঁর ভাইয়ের বহু সিদ্ধান্ত এবং মতামতের আলোচনা করতেন, বিশেষ করে যে মতামতগুলো তাঁর ভাইয়ের শিক্ষাগত এবং গবেষণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করত।
দ্বিতীয় পর্ব অচিরেই প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ।
আরো পড়ুন –
ما شاء الله
شكرا جزاك الله خيرا
মাশাআল্লাহ, আল্লাহ আপনার লেখনীতে বরকত দান করুক।