ইসলামের আগমন : মানবতার পুনঃস্থাপন ও মুসলিম জাতির দায়িত্ব

ইসলামের আগমন : মানবতার পুনঃস্থাপন ও মুসলিম জাতির দায়িত্ব

ইসলামের আগমন মানব সভ্যতার অন্ধকার যুগে একটি আলোকবর্তিকার মতো আবির্ভূত হয়েছিল। এই আলো কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং সমাজের সর্বস্তরের সংস্কার সাধনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামের আগমনের ঐতিহাসিক ভূমিকা, মানবতার পুনঃস্থাপন এবং মুসলিম জাতির ওপর বর্তমান যুগের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করব।

প্রাক-ইসলামী যুগের অন্ধকার (Pre-Islamic Darkness) :

প্রাক- ইসলামী যোগ মহা বর্বরতার যুগ। চুরি, ডাকাতি রাহাজানি আর খুন- খারাবির যুগ। তখনকার আত্মপরিচয়ে সম্মানিত ব্যক্তবর্গ আত্মবিসর্জন দিয়ে অভাবীদের সেবা আর সাহায্য করার পরিবর্তে আত্মপরায়ণতা আর আত্মম্ভরিতার বলে ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় হুংকার ছেড়ে নির্বলের উপর থাবা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়তো। নারীজাতিকে মাতৃত্বের সম্মান না দিয়ে অবিরাম নির্যাতন ও অবমাননার পাত্র বানাতো।চুরি ডাকাতি রাগাজানি দাঙ্গা – হাঙ্গামা ও মূর্তিপূজাসহ বিভিন্ন প্রকার পাপ বৈধ দ্রব্যের ন্যায় গ্রহন করতো। সেই দুর্বিষহ মুহূর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই মানবরূপী হিংস্র পশুদের হুংকারে আত্মসংবরণ করে ফিরতে হতো। তখন সমাজপ্রগতি সুস্থমস্তিষ্ক আর আত্মত্যাগী ব্যক্তিবর্গ জীবনপথে অস্থির হয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভেসে উঠা উন্মুক্ত ঝিনুকের ন্যায় এক সিন্ধু আশা বুকে লালন করে এই পাপ সমাপ্তির অপেক্ষায় থাকলেন। প্রত্যাশায় থাকলেন এক নতুন যুগের,এক মহা মানবের।

ইসলামের আগমন ও মানবতার পুনঃস্থাপন (The Arrival of Islam & Humanitarian Revival):

অবশেষে ইসলাম এলো। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের সুভাগমন ঘটলো। সর্বযোগ সংস্কারকের পদাচরণ পড়লো। অল্প দিনেই তিনি সততা,বিশ্বস্ততা আর ভালবাসা দিয়ে মানুষের মুগ্ধ করলেন।চিন্তা,চেতনা আর গবেষণা দিয়ে তাদের পাপ থেকে রক্ষা করলেন।

কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“আর আমি তোমাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭)

তিনি শিক্ষা, দীক্ষা, আর সঠিক নির্দেশণা দিয়ে সোনার মানুষে রুপান্তর করলেন। সারাজাহানের সর্বশক্তি তাদের মুঠোই এনে দিলেন। ক্ষমতার মসনদ তাদের দখলে এনে দিলেন। সংস্কার করলেন এক সোনালী যোগের। যে সংস্কৃত সমাজের পাপমুক্ত সোনালী পরিবেশ পৃথিবী বহুকাল প্রত্যক্ষ করেছে। অবেশেষে মুসলিম জাতির সেই ঐক্য ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে, সর্বদা শত্রুর উপর বিজয়ী থাকতে কুরআন-সুন্নাহ নামে দুইটি শক্তি রেখে গেলেন। সত্যিই মুসলিমজাতি যদি সেই মহা দৌলতদ্বয় আঁকড়ে ধরে রাখতে পারে তাহলে কখনোই তাদের পদস্খলন ঘটবে না ঈমান থেকে বিচ্যুত হবেনা আর শত্রুর অত্যাচারের শিকারও হবেনা।

ইসলামের সোনালী যুগ ও এর উত্তরাধিকার (The Golden Age of Islam & Its Legacy):

ইসলামের সোনালী যুগ ছিল পৃথিবীজুড়ে মুসলিম সমাজের জন্য এক উন্নতির যুগ। তখন মুসলিমরা শিক্ষা, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ও কলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। ইসলামী সভ্যতার সোনালী যুগ ছিল সমাজে ধর্মীয় ন্যায়, নৈতিকতা এবং জ্ঞানের একটি যুগ। ইসলাম পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করেছে, যেখানে মুসলিমরা কুরআন ও সুন্নাহ অনুসরণ করে নিজেদের জীবনযাত্রাকে শুদ্ধ এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেছে।

হাদিসে এসেছে – তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, কারণ জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।” (ইবনু মাজাহ)

তখন, মুসলিমরা বিজ্ঞানে অগ্রসর ছিল, বিভিন্ন শাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটিয়েছিল এবং পৃথিবীজুড়ে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইসলামিক সংস্কৃতি এবং সভ্যতা আজও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে গভীর প্রভাব ফেলেছে। একমাত্র ইসলামের দৃষ্টিতে, মানবজাতি সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে উন্নতির পথে এগিয়েছিল।

মুসলিম জাতির বর্তমান অবস্থা ও সংকট (Current Situation of the Muslim Ummah):

মুসলিম জাতির বর্তমান অবস্থা অতীতের গৌরবময় দিনের সম্পূর্ণ বিপরীত। এক সময় যারা ছিল জ্ঞান, ঐক্য, ও নেতৃত্বের প্রতীক, তারা আজ সাহায্যের আড়ালে শত্রুর কূটকৌশলের ফাঁদে পড়ে ঈমান নামক মহামূল্যবান সম্পদ হারাচ্ছে। তাদের ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এবং তারা সর্বস্তরে অমুসলিমদের শোষণ ও অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে।সময়ের কিছু ব্যবধানে আজ আরাকান জনগোষ্ঠীর ভিটা ছাড়তে হলো।তাদের রক্তে নাফনদীর সাদাপানি লাল হলো। কাশ্মীর রঞ্জিত হলো । ফিলিস্তিনে মসলিম নিধন আর বাইতুল মাকদিস দখল হলো। চীনের উইঘুর মুসলমানদের স্বাধীনতা খর্ব করা হলো। রাশিয়ায় চেচেন মুসলমানদের‌ নির্মমভাবে নির্যাতন করা হলো। ইতিহাসের রক্তলেখা পাতাগুলোতে এসব ঘটনা স্থান পেয়েছে।

কেন এই দুরাবস্থা?

এই দুরাবস্থা কেন? কেন মুসলিম জাতি আজ এমন করুণ অবস্থার শিকার? এর কারণ কি কেবল বাইরের শত্রুদের ষড়যন্ত্র, নাকি আমাদের নিজেদের ভেতরের দুর্বলতাও এর জন্য দায়ী? এর মূল কারণ নেতৃত্বের অভাব ও ঈমান থেকে বিচ্যুতি। একদিকে মুসলিম শাসকরা আজ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রেখে যাওয়া কোরআন-সুন্নাহর দৌলত ত্যাগ করে ক্ষমতার লোভে শত্রুদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন। তারা নির্যাতিত মুসলিম জাতির প্রতি দায়িত্ব পালন না করে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন।

অপরদিকে সাধারণ মুসলমানরা আল্লাহর হুকুম ত্যাগ করে জাহিলিয়্যাতের কুপ্রথা এবং ডিজিটাল পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণ করছে। নৈতিকতা, আল্লাহর প্রতি ভয়, এবং পরকালীন জীবনের চিন্তা হারিয়ে ফেলেছে।কুরআনে আল্লাহ সাবধান করে বলেন:

“যদি তোমরা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হও, তবে আল্লাহ তোমাদের ওপর শত্রুদের ক্ষমতা প্রদান করবেন।” (সূরা আনফাল: ৫৩)

পুনরুত্থানের পথ: ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা (The Path to Revival: Restoring Legacy and Justice):

মুসলিম জাতির সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো তাদের হারানো ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার এবং কোরআন ও সুন্নাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য।কুরআনে আল্লাহ বলেন:”তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সূরা আলে ইমরান: ১০৩)বর্তমানের বৈশ্বিক দুর্দশা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মুসলিম জাতিকে ঐতিহ্যের মশাল নিয়ে পুনরায় এগিয়ে আসতে হবে। ন্যায় প্রতিষ্ঠা, শত্রুর মোকাবিলা, এবং অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মুসলিমদের রক্ষায় এই ঐতিহ্যই হবে তাদের পথপ্রদর্শক। নতুন প্রজন্মের মুসলিম শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পসহ সর্বক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে নেতৃত্বের যোগ্যতা গড়ে তুলতে হবে।পশ্চিমা বিশ্বের বিভ্রান্তিকর ও বিকৃত সংস্কৃতিকে চিরতরে দূর করে দিতে হবে। তার পরিবর্তে কোরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন ও পবিত্র শিক্ষাকে শক্তভাবে ধারণ করতে হবে। এই ভিত্তিতেই মুসলিম জাতি তাদের হারানো ঐক্য, সম্মান, এবং গৌরবময় অতীত পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।মুসলিম জাতির চিন্তা-চেতনা ও গবেষণা এমন হতে হবে, যা জাতির উন্নতি ও কল্যাণে নিবেদিত। সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আখিরাতের প্রস্তুতিতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে।এভাবেই মুসলিম জাতি আবার তাদের প্রকৃত অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে—একটি ঐক্যবদ্ধ, মর্যাদাসম্পন্ন, এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

উপসংহার (Conclusion):

আজকের মুসলিম জাতি, যাদের হাতে এক সময় ইসলামের সোনালী যুগের শিখর ছিল, তারা আজ নিজেদের ঐতিহ্য হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তবে, তারা যদি কুরআন এবং সুন্নাহর আদর্শ অনুসরণ করে একত্রিত হয়ে কাজ করতে পারে, তাহলে তারা আবার সেই সোনালী যুগে ফিরে যেতে পারবে এবং পৃথিবীজুড়ে ইসলামের সঠিক বার্তা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। মুসলিমদের ঐক্য এবং শক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।

1 thought on “ইসলামের আগমন : মানবতার পুনঃস্থাপন ও মুসলিম জাতির দায়িত্ব”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top